অনিয়ম: কাজ চলাকালীন এ ভাবেই বহু জায়গায় খোলা পড়ে থাকে নির্মাণ সামগ্রী। —নিজস্ব চিত্র।
কাজ করতে হবে ঢেকেঢুকে। কাজে ব্যবহারের জন্য ডাঁই করে রাখা জিনিসপত্রও ঢাকা থাকবে। মাঝেমধ্যে তার উপরে জল ছেটাতে হবে। যাতে ধুলো না ওড়ে, বাতাসে দূষণ ছড়াতে না পারে।
এ সব কথা কয়েক বছর ধরে বলা হচ্ছে ঠিকই, তবে বাড়ির মালিক, প্রোমোটার ও ঠিকাদারদের একটা বড় তা অংশ মানছেন না। তাই অবশেষে নির্মাণকাজ থেকে বায়ুদূষণ রুখতে কী করতে হবে আর কী করা যাবে না, সে সব ব্যবস্থা ‘বিল্ডিং রুল’ বা বাড়ি তৈরির নিয়মাবলিতে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কলকাতা পুরসভা।
গত সপ্তাহে মেয়র পারিষদদের একটি বৈঠকে ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পুরসভা সূত্রের খবর, বাড়ি তৈরির নিয়মের মধ্যে ওই সব ব্যবস্থা থাকার সুবিধা হল বাড়ির মালিক বা প্রোমোটারকে আবেদন করার সময়েই হলফনামা দিয়ে জানাতে হবে বায়ুদূষণ আটকাতে তাঁরা কী কী করবেন আর কী কী করা থেকেই বা বিরত থাকবেন। ফলে, ওই সব নিয়ম ভাঙলে কাজ বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে পুরসভা আরও বেশি ক্ষমতাবান হবে।
কলকাতা পুরসভার জঞ্জাল অপসারণ বিভাগের মেয়র পারিষদ দেবব্রত মজুমদার বলেন, ‘‘কলকাতার বায়ুদূষণ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।
বিভিন্ন নির্মাণস্থল ও নির্মাণ সামগ্রী ওই দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস। ওই দূষণ রোধে ব্যবস্থা না নিলে আমরা কাজ বন্ধ করে দেব। বিল্ডিং
বিভাগের সঙ্গে মিলে আমরা পদক্ষেপ করছি।’’ বিল্ডিং বিভাগের এক শীর্ষ অফিসার বলেন, ‘‘নির্মাণকাজ ও নির্মাণ সামগ্রী থেকে দূষণ রোধের ব্যাপারে পরিবেশ দফতর ও পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এত দিন যে সব পরামর্শ বিভিন্ন সময়ে দিত তার ভিত্তিতে আমরা নির্দেশিকা জারি করতাম। কিন্তু মেয়র পারিষদদের সাম্প্রতিকতম বৈঠকে ওই সব ব্যবস্থা ‘বিল্ডিং রুল’-এ অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’’
পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র বলেন, ‘‘নির্মাণ যেখানে হচ্ছে, সেই জায়গা ও নির্মাণে ব্যবহৃত বালি-সিমেন্ট-পাথরকুচি থেকে হওয়া বায়ুদূষণ রোধে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ার কথা কলকাতা পুরসভাকে আমরা বরাবর বলে আসছি। এখন বিল্ডিং রুল-এ রেখে সেগুলিকে মান্যতা দেওয়া অবশ্যই ভাল পদক্ষেপ।’’
নির্মাণস্থল ও নির্মাণ সামগ্রী থেকে বাতাসে ধুলো ওড়া যতটা সম্ভব কমাতে নভেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ নতুন ভাবে নির্দেশাবলি প্রকাশ করেছে। কলকাতার বায়ুদূষণ নিয়ে রাজ্য সরকারও উদ্বিগ্ন। মাসখানেক আগে নবান্নে মুখ্যসচিব এই নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকও করেছেন।
কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বলছে, নির্মীয়মাণ বাড়ি থেকে ও বাড়ি তৈরির জিনিসপত্র থেকে ওড়া ধুলোয় শুধু শ্বাসযন্ত্রের ক্ষতি হয় না, সমস্যা হয় চোখ, নাক ও গলাতেও।
কেন্দ্রীয় পর্ষদের নির্দেশ, নির্মাণ সামগ্রী ও বাড়ি ভাঙার বর্জ্য ওঠানো-নামানোর জন্য এমন জায়গা বাছতে হবে, যাতে যতটা সম্ভব কম ধুলো ওড়ে। নির্মাণের চৌহদ্দির মধ্যে যানবাহন চলাচলের রাস্তা ভিজে রাখতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে শোধন করা বর্জ্য জল ব্যবহার করাই বাঞ্ছনীয়। নির্মাণ সামগ্রী ও বাড়ি ভেঙে বেরোনো আবর্জনা ওঠানো-নামানো এবং নির্মাণকাজে নিযুক্ত শ্রমিক-মজুরদের যেন মালিক, প্রোমোটার বা ঠিকাদার মুখোশ সরবরাহ করেন। যাতে সূক্ষ্ম ধূলিকণা তাঁদের নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে না ঢোকে। নির্মীয়মাণ বাড়ি এবং মজুত করা নির্মাণ সামগ্রী ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে প্লাস্টিক, তারপলিন কিংবা চটের আবরণ দিয়ে। নির্মাণস্থলের সামনে বাড়ির মালিক, প্রোমোটার বা ঠিকাদার একটি বোর্ড টাঙিয়ে জানাবেন, বায়ুদূষণ রোধে ও শ্রমিক-মজুরদের স্বাস্থ্যরক্ষায় তিনি বা তাঁরা কী কী ব্যবস্থা নিয়েছেন।
তবে পরিবেশ রক্ষার জন্য কয়েক বছর ধরে মালিক বা প্রোমোটারদের বহুতল নির্মাণের আবেদন করার সময়ে পুরসভাকে লিখিত ভাবে জানাতে হচ্ছে, তাঁরা বৃষ্টির জল ধরে বিভিন্ন কাজে লাগাবেন। গভীর নলকূপ খুঁড়ে জল তুলবেন না, এই মর্মেও মুচলেকা দিতে হচ্ছে। কিন্তু এই দু’টি নিয়ম বহু ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না। তাই, নির্মাণজনিত দূষণ রুখতে ‘বিল্ডিং রুল’-এ নতুন ধারা সংযোজন হলেও তা কত দূর কার্যকর করা যাবে, পুরসভার অন্দরেই তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
কলকাতা পুরসভার এক শীর্ষকর্তা জানান, ‘বিল্ডিং রুল’ অমান্য করা হচ্ছে বলে জানা গেলে তাঁরা কাজ বন্ধ করে দেবেন ঠিকই, তবে নিয়ম মেনে কাজ শুরু করার পরে সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে। কিন্তু নিয়ম না মেনে কাজের ফলে যে বায়ুদূষণ হয়েছে, মানুষের যে ক্ষতি হয়েছে, তার জন্য জরিমানা বা ‘দূষণ মূল্য’ আদায়ের আইনি ক্ষমতা পুরসভার নেই।
পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ জানাচ্ছে, তাদেরও সেই ক্ষমতা নেই। কারণ, এ ক্ষেত্রে জরিমানা আদায় করতে হবে বায়ুদূষণ রোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, যা কেন্দ্রীয় আইন। রাজ্যের কোনও সংস্থা বা দফতর ওই আইন অনুযায়ী জরিমানা আদায় করতে পারে না, কেবল কেন্দ্র পারে। তবে অনিয়ম হলে রাজ্যও যাতে জরিমানা আদায় করতে পারে, সেই ব্যাপারে পর্ষদের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রকে শীঘ্রই পাঠানো হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy