Advertisement
০৩ মে ২০২৪
NCERT

স্কুলের বইয়ে ‘ইন্ডিয়া’ পাল্টে ‘ভারত’ লেখার সুপারিশ, বিতর্ক

বাংলা মাধ্যমের পাঠ্যপুস্তকে যদি দেশের নাম ‘ভারত’ থাকে, তা হলে ইংরেজি মাধ্যমের পড়ুয়ারা ‘ইন্ডিয়া’র বদলে ‘ভারত’ পড়তেই পারে। সে ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা হয়।

representational image

—প্রতীকী ছবি।

আর্যভট্ট খান
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৩ ০৭:১১
Share: Save:

দেশের নাম ‘ইন্ডিয়া’র বদলে ‘ভারত’ করার পক্ষে ময়দানে নেমেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এ বার স্কুলে সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ্যপুস্তকেও সেই বদল আনার সুপারিশ করেছেন ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি)-এর বিশেষজ্ঞেরা। যে সুপারিশ ঘিরে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। বিভিন্ন স্কুলের অধ্যক্ষ এবং শিক্ষকদের অনেকেরই প্রশ্ন, সত্যিই কি এই নামবদলের দরকার ছিল? শহরের কিছু স্কুল কর্তৃপক্ষের মতে, বাংলা মাধ্যমের পড়ুয়াদের পাঠ্যবইয়ে দেশের নাম হিসেবে ভারত লেখা আছে। তাই ইংরেজি মাধ্যমের পড়ুয়ারাও সেই নাম জানলে সমতা আসবে। অপর পক্ষের যুক্তি, শিক্ষা ক্ষেত্রের বহু জায়গায় পাঠ্যসূচির পরিবর্তন নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার অবকাশ রয়েছে। তাই দেশের নাম বদল নিয়ে মাতামাতির কোনও কারণ তাঁরা দেখছেন না।

দেশের নাম বদলে স্বাধীনতার ইতিহাস আড়ালে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক অভীক মজুমদার। তাঁর মতে, ‘‘ইন্ডিয়া নামের সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসনকে ছিনিয়ে নিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার ইতিহাস জড়িয়ে। এনসিইআরটি-র বই থেকে ‘ইন্ডিয়া’ নাম মুছে ‘ভারত’ করলে সেই ইতিহাস আড়ালে চলে যাবে। একটা দেশের দু’টো নাম থাকতেই পারে। একটা নাম মুছে ফেলার যুক্তি কী? এনসিইআরটি-তে শুধু ‘ভারত’ করা হলে পড়ুয়াদের সমস্যা হতে পারে। কারণ, অনেক সংস্থার নামের সঙ্গে ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটি জড়িত। যেমন জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া। এই নামগুলি পড়ুয়ারা কী ভাবে পড়বে?’’ হঠাৎ পাঠ্যবইয়ে দেশের নামবদলের যুক্তি দেখছেন না শিক্ষাবিদ তথা মডার্ন হাইস্কুল ফর গার্লসের ডিরেক্টর দেবী কর। তাঁর কথায়, ‘‘স্কুলশিক্ষায় অনেক বড় বড় কাজ পড়ে রয়েছে। পাঠ্যক্রম নিয়ে অনেক ভাবনা-চিন্তার জায়গা আছে। তাই এর বদলে স্কুলশিক্ষায় পাঠ্যক্রমে কী কী বদল আনা দরকার, তা নিয়ে চিন্তা করলে পড়ুয়ারা অনেক বেশি উপকৃত হত। নাম বদলাতে পাঠ্যপুস্তকে যে বদল করতে হবে, তাতেও টাকার অপচয়।’’ একই মত ন্যাশনাল ইংলিশ স্কুলের অধ্যক্ষা মৌসুমী সাহার। তাঁর কথায়, ‘‘পড়ুয়ারা ডিজিটাল ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান আর্মি পড়ছে। হঠাৎ করে সব ভারত হয়ে গেলে তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি হতে পারে।’’ দেবী আবার মনে করছেন, আজকের যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন নতুন পাঠক্রম, যেমন কৃত্রিম মেধা (আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স) এসেছে। তার পাঠ্যক্রম কী ভাবে তৈরি করলে পড়ুয়াদের ভবিষ্যতে কাজ পেতে সুবিধা হবে, সেটা নিয়ে ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। এ ছাড়া, বিশ্ব জুড়ে জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে নিরন্তর গবেষণা হচ্ছে। সে বিষয়েও পাঠ্যক্রমে কী ভাবে পড়ানো হবে, তা নিয়েও শিক্ষাবিদদের ভাবনার পরিসর রয়েছে। সে দিকে নজর না দিয়ে দেশের নাম পাল্টানোর উদ্যোগ স্রেফ সময় নষ্ট বলেই মনে করছেন তিনি।

তবে প্রয়োজনে এই বদলকে স্বাগত জানানোর পক্ষে শিক্ষাবিদ ব্রততী ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “আমরা এখন পশ্চিমবঙ্গকে বিশ্ববাংলা বলছি। ইংরেজরা আমাদের দেশ দখল করার পরে অনেক নাম পাল্টেছে। সেগুলি আবার আগের জায়গায় ফিরে এসেছে। ক্যালকাটা আবার কলকাতা হয়েছে। বম্বে হয়েছে মুম্বই। ইংরেজিতে বর্ধমানের বানান বার্ডোয়ান লেখা হত। এখন আবার আমরা ইংরেজিতেও বর্ধমান লিখছি। কোনও কিছু পাল্টালে যদি তার পরিচয় আরও বেশি শক্তিশালী হয়, তা হলে তা পাল্টাতেই পারে।” ফিউচার ফাউন্ডেশন স্কুলের প্রিন্সিপাল রঞ্জন মিত্র বলছেন, ‘‘এনসিইআরটি-র বইতে ইন্ডিয়ার জায়গায় ভারত হলে পড়ুয়াদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আমরা তো বাংলা ভাষায় যখন লিখি, তখন ভারতই লিখি। বরং বাংলা ও ইংরেজিতে দেশের নাম একই লিখলে পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে সুবিধাই হবে। ইন্ডিয়া তো আর পুরোপুরি মুছে যাচ্ছে না।’’

তবে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেশের নামের বদল হলে তখনই পাঠ্যবইয়েও পরিবর্তন করা যেতে পারে বলে মনে করছেন দ্য হেরিটেজ স্কুলের অধ্যক্ষা সীমা সাপ্রু। তাঁর মতে, ‘‘এখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে ইন্ডিয়ার নাম পাল্টে ভারত হয়নি। তা হলে পাঠ্যবইয়ে নাম পাল্টানো নিয়ে এত তাড়াহুড়ো কিসের? এর ফলে তো পড়ুয়ারাও বিভ্রান্ত হতে পারে।’’ রামমোহন মিশন হাইস্কুলের অধ্যক্ষ সুজয় বিশ্বাসও মনে করেন, শুধু এনসিইআরটি-র পাঠ্যবইয়ে দেশের নাম বদলালে পড়ুয়ারা বিভ্রান্ত হতে পারে।

তবে বাংলা মাধ্যমের পাঠ্যপুস্তকে যদি দেশের নাম ‘ভারত’ থাকে, তা হলে ইংরেজি মাধ্যমের পড়ুয়ারা ‘ইন্ডিয়া’র বদলে ‘ভারত’ পড়তেই পারে। সে ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা হয়। এমনই মত লা মার্টিনিয়ারের সচিব সুপ্রিয় ধরের। ‘‘ইন্ডিয়ার জায়গায় ভারত হলে পড়ুয়াদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এখন আমরা ভারতই বেশি ব্যবহার করছি। এক দেশের একটা নাম থাকলে সব মাধ্যমের পড়ুয়াদের সুবিধা।’’— বলছেন সুপ্রিয়। একই সুর সাউথ পয়েন্ট স্কুলের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য কৃষ্ণ দামানির গলাতেও। তবে একই সঙ্গে তাঁর প্রশ্ন, ‘‘পরীক্ষার খাতায় কেউ অভ্যাসবশত ইন্ডিয়া লিখলে বিভ্রান্তি হবে না তো? উচ্চশিক্ষার জন্য কেউ বিদেশে গিয়ে দেশের নাম ভারত লিখলে, সবাই বুঝতে পারবেন তো?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

NCERT education ministry India Bharat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE