উপহারের প্রলোভন কি হারিয়ে দিয়েছে দানের মানসিকতাকে? রক্তদান শিবিরকে ঘিরে সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা এই প্রশ্নকেই আরও এক বার উস্কে দিল।
রক্তদান শিবিরে উপহারের টোপ নিয়ে চর্চা হচ্ছে কয়েক বছর। রক্তদান আন্দোলনের যাবতীয় নিয়মকে অগ্রাহ্য করে ইদানীং বহু শিবিরেই দাতাদের জন্য দামি উপহারের ব্যবস্থা থাকে। সরকারি তরফে এর নিন্দা হলেও বহু সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক এই সব শিবির থেকে রক্ত সংগ্রহ করে। রক্তদান আন্দোলনের সঙ্গে কয়েক দশক ধরে যুক্ত এক সংস্থার তরফে সম্প্রতি একটি সমীক্ষার আয়োজন করা হয়। তাতেই ধরা পড়েছে উপহারের ভিত্তিতে আয়োজিত রক্তদান শিবিরের সংখ্যাই ঊর্ধ্বমুখী। ফলাফল ৫৫-৪৫। জানা গিয়েছে, উপহারের জন্য আর্থিক সহায়তা আসে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকেই।
‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ভলান্টারি ব্লাড ডোনার্স ফোরাম’ ২০১৬-র জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই সমীক্ষাটি চালায়। কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া ও হুগলির শিবিরগুলি বেছে নেওয়া হয়েছিল। আয়োজকদের একটি প্রশ্নপত্রে শিবিরের উদ্দেশ্য, উপহার দেওয়া হচ্ছে কি না, দিলে তার দাম, উপহার বাবদ টাকার সংস্থান হচ্ছে কোথা থেকে— নানা বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। তাঁদের দেওয়া উত্তরে জানা গিয়েছে, উপহারের দাম ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা। উপহারের টাকা দিচ্ছেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। তাঁদের অনেকেই নানা ব্যবসায়িক কাজকর্মেও যুক্ত। সমীক্ষা বলছে, কলকাতা ও শহরতলিতেই উপহারের রমরমা বেশি। জেলাগুলির রক্তদান শিবিরে উপহারের দাপট এখনও ততটা কাবু করতে পারেনি।
সমীক্ষার আয়োজক সংস্থার সাধারণ সম্পাদক অপূর্ব ঘোষ মনে করেন, এই দিশাহীন রক্তদানে উপকারের বদলে অপকার হচ্ছে বেশি। উপহারের লোভে মানুষ রক্তদানের নিয়মকানুন মানছেন না। রক্ত-সুরক্ষা শিকেয় উঠেছে। তিনি বলেন, ‘‘গঙ্গানগর, বিরাটি ও বারাসতে তিন দাতাকে আমি হাতেনাতে ধরেছি। তাঁরা উপহারের লোভে পরপর তিনটি রবিবার রক্তদান করেছিলেন। এখানে স্ক্রিনিং-এর ব্যবস্থা নেই। তা না হলে হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করলেই বোঝা যেত, ওঁদের রক্ত নেওয়া যাবে কি না।’’
দাতাদের আকৃষ্ট করতে অভিনব উপহারের ব্যবস্থা করছে বহু সংগঠন। মোবাইল, প্রেশার কুকার, ওয়াটার ফিল্টার তো আছেই। পুজোর আগে আবার বারাসতে একটি রক্তদান শিবিরে দাতাদের একটি করে ইলিশ মাছ, ৫০০ গ্রাম সর্ষের তেল ও গুঁড়ো মশলার প্যাকেট উপহার দেওয়া হয়েছিল।
এই সব শিবিরের রক্ত গিয়েছে সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কে। রক্তদান শিবিরের উদ্যোক্তা হিসেবে গোটা রাজ্য জুড়েই একটি পরিচিত নাম সিপিএম নেতা বিমান বসু বলেন, ‘‘বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কগুলি মুনাফার জন্য রক্ত বিক্রি করে। কখনও দ্বিগুণ দামে। তাই রক্ত পাওয়ার জন্য তারা উপহারের আকর্ষণ তৈরি করে।’’ এ ক্ষেত্রে অবশ্য সমীক্ষকেরা জানান, অধিকাংশ ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকেই রক্ত গিয়েছে সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কে।
অজস্র রক্তদান শিবিরের আয়োজক তৃণমূল নেতা পরেশ পাল জানান, তিনি নিজে রক্তদান শিবিরে উপহার দেওয়ার বিরোধী। কিন্তু তাঁর মতে, ‘‘এখন এ ছাড়া উপায় নেই।’’ কেন? তিনি বলেন, ‘‘একটা জামা কিনলে তিনটে জামা ফ্রি মেলে। সময়টা এমনই, উপহারের লোভ না দেখালে কেউ আসবে না। আমি জানি উপহার নিয়ে রক্ত দেওয়া বিক্রি করার সমান। আমি নিরুপায়। মাঝেমাঝে রক্তের আকাল এমন অবস্থায় যায় যে, উপহারের টোপ দিয়ে দাতাদের আকৃষ্ট করা ছাড়া উপায় থাকে না।’’
রক্তদান শিবিরে উপহার দেওয়ার এই চল শুরু করেছিল কিছু বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক। সেখানে নানা উপহার দেওয়া হত। তাদের দেখে নানা ক্লাবও তা চালু করে। নিয়মানুযায়ী, উপহারের ব্যবস্থা থাকা এই সব শিবির থেকে সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কের রক্ত সংগ্রহ করার কথা নয়। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কও এই সব শিবির থেকে রক্ত নিচ্ছে। যে ৫১৬টি রক্তদান শিবিরকে ঘিরে ওই সমীক্ষা চালানো হয়েছিল, তার সব ক’টিতেই রক্ত গিয়েছে সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কে। সবচেয়ে বেশি গিয়েছে সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কে। সবচেয়ে কম সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজে। মাত্র ২ শতাংশ। এ ছাড়া ছিল এসএসকেএম, কলকাতা মেডিক্যাল, এনআরএস, ন্যাশনাল মেডিক্যাল, মানিকতলা ইএসআই।
কী ভাবে সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কগুলি রক্ত সংগ্রহ করল? স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘বহু ক্ষেত্রে উপহারের কথা আগাম জানায় না সংগঠন। শিবিরে পৌঁছে জানতে পারা যায়। তখন আর ফিরে আসার উপায় থাকে না। এখন সরকারি তরফে এ নিয়ে প্রচার শুরু হচ্ছে। উপহার থাকলে যাতে ব্লাড ব্যাঙ্কগুলি কঠোর মনোভাব দেখিয়ে ফিরে আসে, সে ব্যাপারে নির্দেশ জারি হতে চলেছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy