Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

কমিটিই সার, অগ্নিযুদ্ধে শহর সেই নিধিরাম

লালবাজারের ঢিল ছোড়া দূরত্বে পোদ্দার কোর্ট। বাণিজ্যিক ওই বহুতলে শ’খানেকেরও বেশি অফিস। আটতলা বাড়ির প্রতি তলার সিঁড়ির দরজায় লেখা, ‘ফায়ার এগজিট’। প্রতি তলায় রয়েছে আগুন নেভানোর পাইপ। কিন্তু সেই পাইপের রোল যে গ্রিলের দরজার পিছনে ঝোলানো, তাতে তালা ঝুলছে। আটতলায় ছাদে যাওয়ার সিঁড়িতেও লাগানো রয়েছে তালা। ওই বাড়িতে কয়েকটি তলে ‘স্প্রিঙ্কলার’-যুক্ত (জল ছেটানোর যন্ত্র) পাইপ বসানো হয়েছে। কিন্তু কয়েক জন প্রহরী জানালেন, তাতে জল থাকে না।

মার্কেন্টাইল বিল্ডিং। আগুন নেভানোর সরঞ্জাম রয়েছে, কিন্তু জলেরই কোনও সংযোগ নেই।

মার্কেন্টাইল বিল্ডিং। আগুন নেভানোর সরঞ্জাম রয়েছে, কিন্তু জলেরই কোনও সংযোগ নেই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৬
Share: Save:

লালবাজারের ঢিল ছোড়া দূরত্বে পোদ্দার কোর্ট। বাণিজ্যিক ওই বহুতলে শ’খানেকেরও বেশি অফিস। আটতলা বাড়ির প্রতি তলার সিঁড়ির দরজায় লেখা, ‘ফায়ার এগজিট’। প্রতি তলায় রয়েছে আগুন নেভানোর পাইপ। কিন্তু সেই পাইপের রোল যে গ্রিলের দরজার পিছনে ঝোলানো, তাতে তালা ঝুলছে। আটতলায় ছাদে যাওয়ার সিঁড়িতেও লাগানো রয়েছে তালা। ওই বাড়িতে কয়েকটি তলে ‘স্প্রিঙ্কলার’-যুক্ত (জল ছেটানোর যন্ত্র) পাইপ বসানো হয়েছে। কিন্তু কয়েক জন প্রহরী জানালেন, তাতে জল থাকে না।

পোদ্দার কোর্টের উল্টো দিকে টেরিটি বাজারের অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা কী রকম? বাজারের এক ব্যবসায়ী দেখালেন, দমকলের নির্দেশে বিদ্যুৎ সংযোগের তারগুলির কিছু অংশ বিন্যস্ত, তবে অনেক ক্ষেত্রেই নয়। ব্যবসায়ীদের একাংশের অভিযোগ, বহুতলের বেশির ভাগ তলায় (এমনকী একতলাতেও) চলাচলের রাস্তায় দাহ্য পদাথর্র্ মজুত রাখা রয়েছে।

লালবাজারের প্রায় উল্টো দিকে মার্কেন্টাইল বিল্ডিং। বিভিন্ন তলায় দমকলের সুবিধার্থে জলের পাইপ বসানো হয়েছে। কিন্তু তাতে জলের সংযোগ জোড়া হয়নি। বহুতলের একতলায় জলাধার তৈরি হলেও অধিকাংশ সময়েই তাতে জল থাকে না বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। তাঁদের আরও অভিযোগ, জলের পাম্প বসানো হয়েছে। কিন্তু পাম্পই অকেজো।

স্টিফেন কোর্টে আগুন লাগার পরে কলকাতা পুলিশ, দমকল, সিইএসসি, পুরসভার একটি প্রতিনিধি দল প্রায় রোজই নিয়ম করে শহরের বাণিজ্যিক বহুতলগুলির (বিশেষ করে মধ্য কলকাতার) অগ্নি নির্বাপণ পরিস্থিতি সরেজমিন খতিয়ে দেখতে শুরু করে। ওই প্রতিনিধি দল সেই সময়ে পর্যবেক্ষণ করে, বাণিজ্যিক বহুতলগুলির অধিকাংশের অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা বিজ্ঞানসম্মত তো নয়ই, এমনকী বেশ কিছু ক্ষেত্রে অগ্নি-নির্বাপণের সাধারণ ব্যবস্থাটুকুও নেওয়া হয়নি। সেই সময়ে অগ্নি নির্বাপণে কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে, তা নিয়ে ওই সব বহুতলের কেয়ারটেকার বা মালিকদের বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছিল ওই প্রতিনিধি দল।

পোদ্দার কোর্ট। অগ্নি-সুরক্ষার ব্যবস্থা এখানেও বেহাল। বাক্স আছে, কিন্তু তাতে যন্ত্র নেই।

ওই প্রতিনিধি দলে থাকা, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত এক সরকারি অফিসার মঙ্গলবার জানান, শহরের বেশির ভাগ পুরনো বাণিজ্যিক বহুতলে বিকল্প সিঁড়ি নেই। বিদ্যুতের তার আমলের। অধিকাংশ বাড়িতে বড় জলাধারও নেই। তাঁর দাবি, অনেক বলা-কওয়ার পরে কিছু বহুতল অগ্নি-নির্বাপণ বিধি মেনে সবে কাজ শুরু করেছে বটে, তবে অধিকাংশ জায়গাতেই এখনও সেই কাজটাই শুরু হয়নি।

ওই প্রতিনিধি দলে থাকা অন্য এক অফিসার জানান, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাড়ির মালিকেরা সম্পত্তি নিয়ে মামলায় জড়িয়ে রয়েছেন। ফলে কোন অংশীদার অগ্নি-নির্বাপণের ব্যবস্থা নেবেন, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শহরের সব বহুতলে আদৌ অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা নেওয়া যাবে কি না, সে ব্যাপারে সংশয় রয়েছে বলে মনে করেন ওই অফিসার।

২০১১-র ডিসেম্বরে আমরি-কাণ্ডের পরে দেখা যায় শুধু সাবেক কলকাতার পুরনো পাড়াগুলিই নয়, সাম্প্রতিক অতীতের ঝকঝকে বহুতলগুলিও মোটেও নিরাপদ নয়। বর্তমান সরকারের আমলেই তখন গড়ে ওঠে একগুচ্ছ কমিটি। • যেমন, শহরের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল-নার্সিংহোমের অবস্থা খতিয়ে দেখতে দমকলের প্রাক্তন ও বর্তমান কর্তা এবং অগ্নিকাণ্ড বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গড়া হয় ফায়ার সেফটি অডিট কমিটি। • কলকাতা তথা বিভিন্ন শহরে বিল্ডিং আইন ঢেলে সাজতে এক প্রাক্তন পুরকর্তার অধীনে গড়ে ওঠে কমিটি। • পুরসভার বিভিন্ন বরো এলাকায় অগ্নিপ্রবণ বাড়ি সংক্রান্ত কমিটি এবং দমকলের ছাড়পত্র দেওয়ার পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা আনার জন্যও একটি কমিটি মাথা চাড়া দিয়েছে। এতগুলি কমিটির কোনওটিই এখনও পর্যন্ত কাজ শেষ করে উঠতে পারেনি। ফলে কমিটির সদস্যদেরই গ্রাস করছে হতাশা।

কেন এই অবস্থা? নন্দরাম বা স্টিফেন কোর্টের ঘটনার পরে গড়ে ওঠা পরিদর্শক কমিটির সদস্য এক আধিকারিক বলছেন, সমস্যাটা অন্য জায়গায়। কমিটি বড়জোর বার বার সুপারিশ করতে পারে, কিন্তু সেই সুপারিশ অগ্রাহ্য করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে কে?” স্টিফেন কোর্ট-কাণ্ডের পরে শহরের কয়েকটি বাজারের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা করে পরে পিছিয়ে আসে তৎকালীন প্রশাসন। দমকলমন্ত্রী জাভেদ খানের দাবি, তাঁরা ক্ষমতায় এসে অগ্নি-বিধি না-মানায় ১০০ জনকে গ্রেফতার করেছেন। কিন্তু পুলিশের নথিতে সে হিসেব মিলছে না।

টেরিটি বাজার। চলার পথ আটকে মজুত প্লাস্টিক-সহ নানা দাহ্য বস্তু।

২০০৩-এর ২২ এপ্রিল সত্যনারায়ণ পার্কে অগ্নিকাণ্ডের পরে যে সরকারি কমিটি তৈরি হয়েছিল, তার এক জন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক মধুমিতা রায়। কমিটির রিপোর্ট কতটা কার্যকর হয়েছিল? তাঁর জবাব, “আমরা তো প্রশাসনের কাছে আমাদের সুপারিশ জানাই। সেগুলোর খুব কমই কার্যকর করা হয়।”

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “বিভিন্ন দফতর ও বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আর নীতি-নির্ধারণের সর্বোচ্চ স্তরে সদিচ্ছার অভাব এর মূল দুই কারণ।” আমরি-র অগ্নিকাণ্ডের পরেও প্রশাসনের কাছে বিশদ রিপোর্ট দিয়েছিলেন তিনি। এ কথা জানিয়ে মধুমিতাদেবী বলেন, “প্রস্তাবগুলোর বেশির ভাগই ফাইলবন্দি হয়ে থাকে।”

ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE