Advertisement
E-Paper

ক্লান্তি নামলেও ফুরোবে না এ যাত্রা

রথের দিনেই শুরু হবে যাত্রার বায়না ।

জয়তী রাহা

শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৮ ০১:৪৩
 প্রতীক্ষা: রথের দিনেই শুরু হবে বায়না নেওয়া। চলছে তারই প্রস্তুতি। ছবি: সুমন বল্লভ

 প্রতীক্ষা: রথের দিনেই শুরু হবে বায়না নেওয়া। চলছে তারই প্রস্তুতি। ছবি: সুমন বল্লভ

এক অলস দুপুর। বৌবাজার অঞ্চলের বাড়িটায় বৈঠকখানায় তখন তুঙ্গে আলোচনা। যোগ দিয়েছে মতিলাল গোষ্ঠী, বাঁড়ুজ্যে গোষ্ঠী, ধর গোষ্ঠী। রাতেই যাত্রার মহড়া। সে সবে ছেদ টানল এক সুরেলা কণ্ঠ, ‘চাই চাঁপাকলা’। কে যায়? বিশ্বনাথ মতিলালের তলবে ধরে আনা হল ফেরিওয়ালাকে।

নাম কী? গোপাল উড়ে। কোথায় বাড়ি? বয়স কত?... চলল প্রশ্নবাণ। খানিক বিব্রত হয়ে উত্তর দিতে থাকলেন ওড়িশার জাজপুরের সদ্য কৈশোর পেরনো সেই যুবক। আড্ডায় উপস্থিত রাধামোহন সরকার সকলের সামনেই আগামী বিদ্যাসুন্দর যাত্রায় মালিনী চরিত্রের জন্য মাসিক দশ টাকায় গোপালকে বেছে নিলেন। সম্ভবত সেটাই কলকাতার প্রথম শখের যাত্রা।

বাকিটা ইতিহাস। বাবুদের ওস্তাদ হরিকিষণ মিশ্রের তত্ত্বাবধানে চলল তাঁর সঙ্গীতশিক্ষা। এক বছরেই গোপাল আয়ত্ত করলেন ঠুংরি। বছর খানেক পরে সম্ভবত ১৮৪২ সালে শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেবের বাড়িতে বিদ্যাসুন্দর প্রথম মঞ্চস্থ হল। গান-নাচ-অভিনয়ে সাড়া ফেলে দিলেন গোপাল। তাঁর মাইনে এক লাফে হল পঞ্চাশ টাকা।

রাধামোহনের মৃত্যুর পরে নিজেই দল গড়েন গোপাল। শোনা যায়, সহজ বাংলায় গান লিখে এবং সুর দিয়ে বিদ্যাসুন্দর যাত্রাকে আরও জনপ্রিয় করেন তিনি। সে ভাবে কোনও তথ্য পাওয়া না গেলেও সম্ভবত সেটাই ছিল চিৎপুরের একটা অংশের যাত্রাপাড়া হয়ে ওঠার সূচনা। দেড়শো বছরের বেশি সময় পেরিয়েছে। এর পরিধি এখন নতুনবাজার থেকে অ্যালেন মার্কেটের আগে পর্যন্ত। যদিও নট্ট কোম্পানির মতো দু’একটি গদিঘর ছিল তার বাইরে|

আজ থেকে বছর চল্লিশ আগেও তক্তপোষে বসতেন যাত্রার মালিক অর্থাৎ সরকারবাবুরা। আর যাত্রার বায়না করতে আসা বিশিষ্ট নায়েকরাই শুধু বসতেন সেখানে। বাকিদের স্থান হত বেঞ্চে বা চেয়ারে। সেই তক্তপোষ নেই। তাই গদিঘর বদলে হয়েছে অফিসঘর। দল পরিচালক অর্থাৎ ম্যানেজারেরা বসেন সেখানেই।

চিৎপুর যাত্রাপাড়ার গা ঘেঁষা অফিসঘর এখন উধাও। কারণ অনেকেই ঝাঁপ ফেলে দিয়েছেন। সাকুল্যে ১৫-১৬ ঘর অফিস রয়েছে। কিছু আবার পিছনের ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উঠে কেবিনের মতো ঘুপচি ঘরেও আছে। এ বছর ৫৬টি দল। একটি সংস্থার পাঁচ-ছ’টি দলও থাকে। ৪০-৪৫ জনকে নিয়ে দল হয়। সে ক্ষেত্রে দু’এক জন মূল অভিনেতাকে বদলে তৈরি হয় অন্য দল।

রথের দিন আলো-ফুল দিয়ে সাজানো অফিসঘরে থাকত এলাহি আয়োজন। গোলাপ জল, মিষ্টিমুখ, শরবত আর ক্যালেন্ডারে চলত অতিথিসেবা। নায়েকরা যৎসামান্য দিয়ে নির্দিষ্ট দিনে পালা বুক করে যেতেন। বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু হত ওই দিনেই। আবশ্যিক ভাবে থাকত পুজোপাঠ। যাত্রা নিয়ে প্রভাতকুমার দাসের লেখা বই থেকে এমনই ছবি উঠে আসে। এমনকি মালিকেরা পালাকার, সুরকারদের কিছু অগ্রিম টাকা দিতেন। যাত্রার ভাষায় যা হল সাইদ। রথের দিনে নতুন পালায় সুরও দিতেন সুরকার। এটাই হল সুরভাঙা।

জীবনের ৩৭ বসন্ত এ পাড়ায় কাটিয়েছেন আকাশবাণী সংস্থার দল পরিচালক প্রশান্ত সাহা। উদাস দৃষ্টিতে বলে চলেন— দশ বছর হয়ে গেল পালার ছবি দিয়ে ক্যালেন্ডার হয় না। তবে জগন্নাথের পুজো হয়। নায়েকদের প্রসাদ-মিষ্টি দেওয়া হয়। নতুন পালার জানান দিতে আলো সাজানো অফিসঘরের সামনে ঝাঁ চকচকে বোর্ড, দেওয়াল জোড়া লিথোর পোস্টার লাগানো হয়।

হালখাতার উৎসবে দোকানের সামনের ভিড়ের ভাটা নেমেছে এখানেও। কারণ ব্যাখ্যায় অন্য কথা শোনাচ্ছেন পরিচালক তথা অভিনেত্রী রুমা দাশগুপ্ত। ‘ষষ্ঠী থেকে জষ্ঠী’ যাত্রার এই প্রবাদ আজও মানা হয়। তবে যাত্রা এখন শুধু চিৎপুরেই আটকে নেই। চিৎপুরের বিভিন্ন সংস্থার শাখা অফিস এবং স্থানীয় যাত্রাসংস্থা এখন বেলদা, রানিগঞ্জ-সহ জেলার অন্যত্রও গজিয়েছে। তাই চিৎপুর পাড়ায় বায়নার ভিড় হয়ত নজরে পড়ে না। তাঁর কথায়, এত পুরনো লোকসংস্কৃতিতে রোগ বাসা বাঁধতেই পারে, তার প্রতিকারও চলছে। জেলা-গ্রাম থেকে প্রতিভা খুঁজে আনা হচ্ছে।

বদলে যাওয়া যাত্রা নিয়ে পালাকার সুনীল চৌধুরীর আক্ষেপ— আগে যাত্রায় থাকত ৩০-৩২টা গান। সেটাই আকর্ষণ। তাই গান লেখা আর সুর বাঁধা ছিল বড় পর্ব। এখন সাকুল্যে ১০-১২টা গান থাকে। বেশির ভাগই জনপ্রিয় হিন্দি-বাংলা গানের রেকর্ড চালিয়ে দেয়। এমনকি উঠে গিয়েছে পুরনো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের রেওয়াজ। এ সবে ক্ষতি হচ্ছে যাত্রার ভাবমূর্তি।

যাত্রা মানে যাওয়া বা পথ চলা। গবেষকদের মতে, এই যাত্রা রয়েছে পুরাণেও। তবে প্রামাণ্য তথ্য বলছে সাড়ে পাঁচশো বছরের পুরনো এ যাত্রা। কৃষ্ণলীলা আর রামলীলা যাত্রায় নারীর ভূমিকায় চৈতন্য মহাপ্রভুর অভিনয় বাংলা ছাড়িয়ে বিহার ও ওড়িশায় উন্মাদনা ছড়ায়। নিন্দুকেরা বলেন, শেষের সে দিন আসন্ন। যাত্রাপ্রেমীরা বলেন, ক্লান্তি নামলেও ফুরোবে না এ যাত্রা। চিৎপুর যতদিন থাকবে, পরতে পরতে জড়িয়ে থাকবে অনন্ত যাত্রা।

Chitpur Jatra যাত্রা Rath Festival Heritage
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy