Advertisement
E-Paper

চল্লিশ বছর ‘বিচারাধীন’, অবশেষে মুক্তি পেলেন বৃদ্ধ

শনিবার দুপুরে দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের গেটের বাইরে তখন উপচে পড়া ভিড়। চল্লিশ বছর পরে এক জন বিদেশি বিচারাধীন বন্দি জামিনে মুক্তি পেলেন। ভিড় জমেছিল তাঁকে এক বার দেখতে।

বিতান ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২১ ০৫:৩৯
 অভিনন্দন: চল্লিশ বছর পরে মুক্ত হয়ে সংশোধনাগারের বাইরে এলেন দীপক জোশী। তাঁকে স্বাগত জানাতে হাজির শুভানুধ্যায়ীরা। শনিবার, দমদমে।

অভিনন্দন: চল্লিশ বছর পরে মুক্ত হয়ে সংশোধনাগারের বাইরে এলেন দীপক জোশী। তাঁকে স্বাগত জানাতে হাজির শুভানুধ্যায়ীরা। শনিবার, দমদমে। স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

জেলের কুঠুরির চার দেওয়ালের মধ্যেই কেটে গিয়েছে চল্লিশটা বছর। জেলই তাঁর দ্বিতীয় পৃথিবী হয়ে গিয়েছিল। অন্য বন্দিদের তবু আদালতে হাজিরা দিতে গরাদ আর উঁচু প্রাচীরের সীমানা ছাড়িয়ে বেরোনোর সুযোগ হয়। কাছের মানুষদের চোখের দেখা বা আঙুলটুকু স্পর্শ করা যায়। তাঁর অবশ্য হাজিরার ডাক আসত না। কাছের মানুষেরা জানতেনও না যে, তিনি বেঁচে আছেন!

শনিবার দুপুরে দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের গেটের বাইরে তখন উপচে পড়া ভিড়। চল্লিশ বছর পরে এক জন বিদেশি বিচারাধীন বন্দি জামিনে মুক্তি পেলেন। ভিড় জমেছিল তাঁকে এক বার দেখতে। কারণ, এতটা দীর্ঘ সময়ের পরে কোনও বিচারাধীন বন্দির জামিন নজিরবিহীন ঘটনা বলেই উল্লেখ করেছে হাইকোর্ট। নেপালের ইলম জেলার মেচি গ্রামের বাসিন্দা দীপক জোশী ১৯৮০ সালে দার্জিলিঙে এক মহিলাকে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হন। তখন দীপক সদ্য যুবক। আর এ দিন যখন জেলের গেট পেরিয়ে খোলা আকাশের নীচে পিচ রাস্তায় তিনি পা রাখলেন, কপালে আর মুখে বলিরেখা স্পষ্ট। নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি। গলায় রজনীগন্ধার মালা। তাঁকে ঘিরে তখন পুলিশ, আইনজীবী, সাধারণ মানুষের উচ্ছ্বাস। তবে জেলের হসপিটাল ওয়ার্ড ছেড়ে আসা দীর্ঘদেহী মানুষটি অবশ্য ভাবলেশহীন, নিরুত্তাপ।

দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের সুপার শুভেন্দুকৃষ্ণ ঘোষ-সহ অন্য আধিকারিক ও জেলকর্মীরা ভিতরের গেট পর্যন্ত হাত ধরে এগিয়ে দিতে এসেছিলেন বছর পঁচাত্তরের দীপককে। গেটের বাইরে নেপালি দূতাবাসের অফিস সেক্রেটারি সতীশ থাপা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। তিনিই দীপককে রবিবার সকালের মধ্যে নেপালে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে দেবেন। গেটের সামনে বিদেশি চ্যানেলের সাংবাদিক নাগাড়ে প্রশ্ন করে চললেন তাঁর মুক্তির উপলব্ধি নিয়ে। দীপক নিশ্চুপ। গত কয়েক বছরে আর কথা বলেননি তিনি। হাইকোর্টের নির্দেশে নিযুক্ত মনোবিদেরা জানিয়েছেন, দিশাহীন বন্দি জীবনের ফলে দীপকের বর্তমান মানসিক অবস্থা একটি ন’বছরের শিশুর মতো। তাঁর সহবন্দিরাও জানান, এক সময়ে বাইরে বেরোনোর আর্জি জানাতে জানাতে ক্লান্ত দীপক চুপ করে গিয়েছেন পুরোপুরি। তাঁর হয়ে উত্তর দিলেন আইনজীবী হীরক সিংহ। বিনা পারিশ্রমিকে দীপক জোশীর পাশে ছিলেন গত নভেম্বর থেকে। তিনি বলেন, ‘‘এই ঘটনা নজিরবিহীন। দীপক আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে আইনি ব্যবস্থার খামতিগুলো দেখিয়ে দিলেন।’’

কারাগারের অন্তরালেই হয়তো থেকে যেত এই কাহিনি, যদি না নন্দীগ্রাম-কাণ্ডে জেল খেটে আসা রাধেশ্যাম দাসের সঙ্গে গত ১৬ অক্টোবর ওয়েস্ট বেঙ্গল রেডিয়ো ক্লাবের সেক্রেটারি অম্বরীশ নাগ বিশ্বাসের যোগাযোগ হত। দীপকের কথা তাঁর কাছে শুনে বিষয়টি নেপালি দূতাবাসের মাধ্যমে নেপাল সরকারের নজরে আনেন অম্বরীশবাবুই। তিনি বলেন, ‘‘দীপককে নেপালের নাগরিক বলে প্রথমে মানতে অস্বীকার করে দূতাবাস। কিন্তু সংবাদপত্রে গত ৮ নভেম্বর ও তার পরে ধারাবাহিক ভাবে দীপক জোশীর খবর প্রকাশিত হওয়ার পরেই নড়েচড়ে বসে আদালত থেকে জেল, এমনকি দূতাবাসও।’’ হ্যাম রেডিয়োর নেপালের সদস্যেরাই গত নভেম্বরে পূর্ব নেপালের একটি দুর্গম এলাকায় লুম্বক গ্রামে দীপকের মা ও ভাইকে খুঁজে বার করেন।

কেন এত দিন দীপক শুধুমাত্র বিচারাধীন বন্দি হয়ে রইলেন, তা নিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে মামলা করে কলকাতা হাইকোর্ট। দার্জিলিঙের দায়রা আদালতকে দু’দিনের মধ্যে দীপক জোশীর মামলার সমস্ত তথ্য দিতে নির্দেশ দেয় হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টি বি রাধাকৃষ্ণনের ডিভিশন বেঞ্চ। নেপালি দূতাবাসকেও নোটিস পাঠানো হয়। ১৬টি শুনানির পরে শুক্রবার দীপকের খুড়তুতো ভাই প্রকাশচন্দ্র শর্মা তিমসিনার বন্ডে জামিনের নির্দেশ দেন বিচারপতিদের ডিভিশন বেঞ্চ।

এই মামলায় রাজ্য আইনি পরিষেবা কেন্দ্রের পক্ষে দাঁড়ানো আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এক কথায় বলব, সদিচ্ছার অভাব ছিল সব স্তরেই। তাই অহেতুক একটা মানুষের জীবন থেকে এতটা সময় নষ্ট হয়ে গেল।’’

Kolkata
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy