দূষিত: আর্বজনায় ঢাকা ধর্মতলার এক শৌচালয়। রক্ষণাবেক্ষণেরও বেহাল দশা।
সুলভ এখনও দুর্লভ!
কিছু দিন অন্তর ঘটা করে শৌচালয়ের উদ্বোধন হয় নানা প্রান্তে। যাতায়াতের পথে সে সব যে চোখে পড়ে না, তেমন নয়। তবু দিনভর কোনও মহিলাকে পথে ঘুরতে হলে টের পাওয়া যায়, কলকাতায় সাধারণ পরিকাঠামো এখনও কত দুষ্প্রাপ্য।
শিয়ালদহ চত্বরে কাজের ফাঁকে প্রয়োজন পড়ায় এগিয়ে যাওয়া গেল স্টেশনের সামনের এক মহিলা দোকান মালিকের দিকে। বাথরুম কোথায় জানতে চাওয়া হলে মাঝবয়সী ওই মহিলা জানান, ‘‘ব্রিজের ও দিকে একটা সুলভ আছে। কিন্তু অনেকটা হাঁটতে হবে। এই এলাকাটা না চিনলে খুঁজেও পাবেন না।’’ প্রয়োজনের সময়ে অত দূর হেঁটে যান তাঁরা? দোকানির উত্তর, ‘‘সামনে একটা গেস্ট হাউসে যাই। তার জন্য প্রতি মাসে মোটা টাকা দিতে হয়।’’ ফলে সেই এলাকায় হঠাৎ বিপদে পড়লে অন্য মহিলাদেরও তেমনই কোনও জায়গার শরণাপন্ন হওয়ার উপদেশ দেন তিনি। আর নিরাপত্তার দিকটা? ‘‘প্রয়োজনের সময়ে কি অত ভাবা যায়? মেয়েরা তো আর রাস্তায় যেতে পারবে না,’’ পাশ থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন তাঁর এক মহিলা সহকর্মী। তাঁদের ক্ষোভ, ছেলেরা শৌচাগার থাকা সত্ত্বেও বহু ক্ষেত্রেই রাস্তাঘাট নোংরা করেন। যার জন্য রাস্তা দিয়ে চলাই দায়। আর মেয়েরা রাস্তায় বেরোতে হলেই জল কম খান, যাতে মাঝপথে সমস্যায় না পড়তে হয়। অথচ তার থেকে যে কত সমস্যা হয়, তা দেখবে কে!
শৌচাগার নিয়ে সমস্যা অবশ্য শুধু এই তল্লাটে নয়। শহরের সব প্রান্তেই পরিস্থিতি কার্যত এক। উত্তরের কলেজ স্ট্রিট, শ্যামবাজার হোক বা দক্ষিণের যাদবপুর। ফলে বেশি ক্ষণের জন্য পথে বেরোলে জল কম খাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। ধর্মতলায় দূরপাল্লার বাস থেকে নেমে, তেমনই বলছিলেন খড়দহের বাসিন্দা এক তরুণী। একদল কলেজপড়ুয়া তখন ঠিক করে ফেলেছেন, মেট্রোয় ওঠার আগে ট্যাক্সি ধরে ঘুরে আসবেন রবীন্দ্র সদন চত্বর থেকে। সিনেমা-নাটক নয়, উদ্দেশ্যটা শৌচাগার। বছর বাইশের তরুণী রোমিলা বলছিলেন, ‘‘ডাক্তার বলেছেন, পরিষ্কার জায়গা দেখে যেতে। কত রকম অসুখ হয় অপরিচ্ছন্ন শৌচাগার থেকে। কিন্তু আমরা করব কী? রাস্তায় বেরোলে কত সমস্যা হয়, সেটা মেয়েরাই জানে!’’ ধর্মতলায় যে কোনও ‘পাবলিক টয়লেট’ নেই, তেমন নয়। সরকারি বাস ডিপোর মধ্যেও আছে ‘পে অ্যান্ড ইউজ টয়লেট।’ সে দিকেই প্রথমে এগিয়েছিলেন তরুণীরা। কিন্তু দরজার সামনে জল থই থই পরিবেশ দেখে ঢোকার সাহস পাননি।
ইতিমধ্যেই শহরের একটি হাসপাতালের উদ্যোগে শুরু হয়েছে সমীক্ষা। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আগেই প্রকাশিত হবে তার রিপোর্ট। এ শহরের পথে বেরিয়ে পরিচ্ছন্ন শৌচাগারের অভাব মহিলাদের কত বড় ভোগান্তির কারণ এবং তার জেরে কী কী শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়, তা-ই প্রকাশিত হবে সেই রিপোর্টে।
মৌলালি অঞ্চলের একটি শৌচালয়। নিজস্ব চিত্র
পুরসভার হিসেব অবশ্য বলছে, শুধু কলকাতা পুর এলাকায় এ পর্যন্ত ৩৭০টি শৌচালয় তৈরি করা হয়েছে। ২-৩ টাকার বিনিময়ে তা ব্যবহার করতে পারেন মহিলারাও। তবে সেই ব্যবস্থাপনা যে যথেষ্ট নয়, শহরের পথেঘাটে কাজে বেরোনো মহিলাদের নানা অভিজ্ঞতা সে কথা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। অহরহ এমন হয় যে কাজে বেরিয়েই মহিলারা আশপাশের শপিং মল খোঁজেন, সেখানকার শৌচালয় ব্যবহারের জন্য। শুধু তা-ই নয়, গটগট করে পাঁচতারা হোটেলে ঢুকে পড়েন শুধু শৌচাগার ব্যবহার করতে, এমন মহিলাও প্রচুর এ শহরে।
যেমনটা হল কলেজ স্ট্রিট চত্বরে গিয়ে। জমজমাট কলেজ পাড়ায় হঠাৎ প্রয়োজনে পড়লে যান কোথায় মহিলারা? নিত্য যাতায়াত করা কৃষ্ণনগরের স্কুল শিক্ষিকা চন্দনা দাম জানালেন, আগে প্রেসিডেন্সি চত্বরে ঢুকতেন। কিন্তু এখন সেখানে যেতে পরিচয়পত্র লাগে। এক দিন বিপদে পড়ে খুঁজে পেয়েছেন কলেজ স্কোয়ারের শৌচালয়। অচেনা মহিলার সমস্যার কথা শুনে, তাঁকেও ওই জায়গাই খুঁজে নিতে বললেন। সঙ্গে সাবধাবাণী, ‘‘লাইন থাকে কিন্তু!’’
শ্যামবাজার চত্বরে গিয়ে দেখা মেলেনি কোনও চন্দনা কিংবা দোকানি দিদিমণির। মাথা ঘামিয়ে বার করতে হল অন্য পথ। ইন্টারনেটে সার্চ দিতে বেরিয়েও পড়ল, ‘টয়লেটস নিয়ার মি’-র তালিকা। কিন্তু সেই ঠিকানা খুঁজে বার করবে কে? সঙ্গে ছিল গাড়ি। চালক ভাই চললেন, ইন্টারনেটের বলে দেওয়া শৌচাগারের খোঁজে। কিন্তু ভরদুপুরের উত্তর কলকাতায় পার্কিং পাওয়া কঠিন। তাই হাতিবাগান থেকে শৌচালয়ের খোঁজে বেরিয়ে মিনিট পনেরো পরে গাড়ি দাঁড়ানোর সুযোগ পেল অবশেষে কেশব সেন স্ট্রিটের মুখে। যা দেখে চালক বলেই ফেললেন, ‘‘একটা ম্যাপ থাকলে ভাল হয় দিদি। প্রয়োজনে তবে সেই দিকেই গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy