—প্রতীকী চিত্র।
সাত বছরের ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার মিনিট পনেরোর মধ্যে স্কুল থেকে ফোন আসে, শৌচালয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে সে। মৃত। পাশেই রক্তমাখা ছুরি। তদন্তে উঠে আসে, স্কুলেরই শৌচালয়ের ভিতরে স্কুলবাসের কন্ডাক্টর খুন করেছে দ্বিতীয় শ্রেণির ওই ছাত্রকে।
শুক্রবার গুরুগ্রামের এই ঘটনায় শোকস্তব্ধ বাবা-মায়ের প্রশ্ন, ‘‘স্কুলে পাঠিয়ে জানব কী করে, বাচ্চার সঙ্গে কী হচ্ছে?’’
আরও পড়ুন: মিছিলের ফাঁসে ফের নাস্তানাবুদ মহানগর
বস্তুত, প্রশ্নটা উঠেছে সব মহলেই। অভিভাবকেরা রীতিমতো চিন্তিত, স্কুলে সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে। এতটা সময় বাচ্চারা যেখানে পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কাটায়, সেখানে তারা কতটা সুরক্ষিত?
শহরের বেশির ভাগ বড় স্কুল জানাচ্ছে, বাচ্চাদের সুরক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টা তাদের তরফে করা হয়। তবে তারা এ-ও স্বীকার করে নিচ্ছেন, চেষ্টার ত্রুটি না-রেখেও গুরুগ্রামের মতো ঘটনা এড়ানো কতটা সম্ভব, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েই যাচ্ছে।
বালিগঞ্জের এলাকার এক অতি-পরিচিত স্কুলের কর্তৃপক্ষের তরফে কৃষ্ণ দামানি যেমন বলেন, ‘‘স্কুলের নিরাপত্তারক্ষী বা যে কোনও অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে বিস্তারিত সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।’’ সম্প্রতি দেশের প্রথম স্কুল হিসেবে, স্কুলে ঝুঁকি এবং দুর্ঘটনার আশঙ্কা কমানোর বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড ইনস্টিটিউটের (বিএসআই) কাছ থেকে শংসাপত্রও পেয়েছেন তাঁরা।
বালিগঞ্জে এলাকায় মেয়েদের একটি নামী স্কুলের ডিরেক্টর দেবী কর আবার জানালেন, স্কুলে নিয়োগ করার সময়ে সব পুরুষ কর্মীর ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন করানো হতো এত দিন। ‘‘কিন্তু গুরুগ্রামের ঘটনার পরে মহিলাদের ক্ষেত্রেও এমনটা করার কথা ভাবছি আমরা,’’ বলেন তিনি।
তবে শুধু স্কুলের উপরে ভরসা নয়। সন্তানের নিরাপত্তার বিষয়ে অভিভাবকদের আরও বেশি করে সচেতন হওয়া উচিত বলে মনে করেন বাগুইআটির চয়িতা ঘোষ। পাঁচ বছরের মেয়ের মা চয়িতা বলছিলেন, ‘‘আমাদের বাড়ি পর্যন্ত স্কুলগাড়ি আসে না। অনেকটা অসুবিধা হলেও বাচ্চাকে নিজেরা স্কুলে দেওয়া-নেওয়া করি। পুলকারে ছাড়ি না।’’ শুধু তা-ই নয়, বাচ্চার সঙ্গে কখনও কিছু ঘটলে সে যাতে বাড়ি এসে সবটা জানায়, সে শিক্ষাও অভিভাবকদের দেওয়াই কর্তব্য বলে মনে করালেন তিনি। এ জন্য তিনি প্রতিদিন মেয়ের কাছে খুঁটিয়ে জানতে চান, সারা দিন কী কী হয়েছে স্কুলে।
তবে আর এক মা অনন্যা ভট্টাচার্যের আবার চিন্তা, ‘‘নিজের যতটুকু করণীয়, তা না হয় করলাম। কিন্তু স্কুল যতটা নিরাপত্তার আশ্বাস দিচ্ছে, ততটাই পালন করছে কি না, বাইরে থেকে তা কী করে বুঝব?’’
শহরের বিভিন্ন স্কুলে বাস সরবরাহকারী সংস্থা ‘পশ্চিমবঙ্গ কনট্র্যাক্ট ক্যারেজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর তরফে হিমাদ্রি গঙ্গোপাধ্যায় জানালেন, প্রতি বছর কলকাতা পুলিশের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে স্কুলগাড়ির চালক-খালাসিদের নিয়ে সচেতনতা শিবির করেন তাঁরা। তাঁদের অধীনে কাজ করা সব কর্মীর বিস্তারিত নথি জমা করেন পুলিশের কাছে। তবে গুরুগ্রামের ঘটনার পরে তাঁরা ভাবছেন, সব বাসে বাচ্চাদের দেখভাল করার জন্য এক জন করে মহিলা রাখবেন এর পর থেকে।
বালিগঞ্জের একটি স্কুলের বাসগুলিতে এমনই দু’জন করে মহিলাকর্মী থাকেন বলে দাবি কর্তৃপক্ষের। আনন্দপুর এলাকার এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের তরফে অধ্যক্ষা সীমা সপ্রু জানালেন তাঁদের স্কুলবাসেও এই ব্যবস্থা থাকে। শুধু তা-ই নয়, পুলকারের অনুমতিই নেই ওই স্কুলে। স্কুলবাসগুলি বাইরের সংস্থা থেকে ভাড়া করলেও, চালক-কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করেন তাঁরা। গুরুগ্রামের ঘটনার পরে ওই স্কুলের পড়ুয়াদের সব অভিভাবককে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে, তাঁরা যেন স্কুল শুরুর পাঁচ মিনিটের বেশি আগে সন্তানকে স্কুলে না ঢোকান।
কিন্তু যদি কখনও স্কুল শুরুর একটু আগে পৌঁছেই যায় পড়ুয়া বা কোনও কারণে তাকে ছুটির পরে কিছু ক্ষণ থাকতে হয়, তখন নিরাপত্তার দায়িত্ব কি নেবে না স্কুল? দক্ষিণ কলকাতার বহু পুরনো এক নামী স্কুলের সচিব সুপ্রিয় ধর জানালেন, দায়িত্ব অবশ্যই স্কুলের। এ জন্য তাঁর স্কুলে মোট ৫৫০টি সিসিটিভি রয়েছে।
২০০৯ সালে পাশ হওয়া শিক্ষার অধিকার আইনে স্পষ্ট ও কড়া ভাবে বলা হয়েছিল, পড়ুয়ারা যে সময়টুকু স্কুলের ভিতরে থাকে, সে সময়ে তাদের নিরাপত্তার সব দায়িত্ব স্কুল কর্তৃপক্ষের। এ বিষয়ে নির্দেশিকাও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু স্কুলগুলি তা কতটা মানছে, তার খোঁজ রাখবে কে? পুলিশের এক কর্তার কথায়, নির্দেশিকা প্রশাসন দিতে পারে। কিন্তু তা মেনে চলার জন্য স্কুলে স্কুলে নজরদারি করা প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য স্কুলের কর্তৃপক্ষকেই সচেতন হতে হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy