Advertisement
E-Paper

লাগাতার হর্নে বাড়ছে ব্যাধি, মত চিকিৎসকদের

বাসচালকের পাশের সিটে বসে কোচিং সেন্টারে যাচ্ছিলেন মানিকতলার বাসিন্দা বাংলা অনার্সের ছাত্র চিরদীপ নিয়োগী। আচমকা বেসরকারি বাসের হর্নের শব্দে বাঁ কানে তালা লেগে যায়। রাতে অসহ্য যন্ত্রণা। পরীক্ষায় দেখা যায়, কানের ভিতরের কোষগুলি এয়ারহর্নের মাত্রাছাড়া শব্দে চিরকালের মতো খারাপ হয়ে গিয়েছে। শুধু চিরদীপই নয়, কলকাতায় এ রকম উদাহরণ অসংখ্য। বিকট হর্নের দাপটে প্রতিদিনই কিছু মানুষ পাকাপাকি বা অস্থায়ী ভাবে বধির হয়ে যাচ্ছেন বলে উদ্বিগ্ন শহরের ইএনটি বিশেষজ্ঞরা।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৫ ০৪:১৩

বাসচালকের পাশের সিটে বসে কোচিং সেন্টারে যাচ্ছিলেন মানিকতলার বাসিন্দা বাংলা অনার্সের ছাত্র চিরদীপ নিয়োগী। আচমকা বেসরকারি বাসের হর্নের শব্দে বাঁ কানে তালা লেগে যায়। রাতে অসহ্য যন্ত্রণা। পরীক্ষায় দেখা যায়, কানের ভিতরের কোষগুলি এয়ারহর্নের মাত্রাছাড়া শব্দে চিরকালের মতো খারাপ হয়ে গিয়েছে।
শুধু চিরদীপই নয়, কলকাতায় এ রকম উদাহরণ অসংখ্য। বিকট হর্নের দাপটে প্রতিদিনই কিছু মানুষ পাকাপাকি বা অস্থায়ী ভাবে বধির হয়ে যাচ্ছেন বলে উদ্বিগ্ন শহরের ইএনটি বিশেষজ্ঞরা। বর্ষীয়ান চিকিৎসক দুলাল বসু বলছিলেন, ‘‘ধীরে-ধীরে আমাদের কানকে মেরে ফেলছে হর্ন। মনকে বিক্ষিপ্ত, অস্থির করছে। কানে কম শোনা, মাথা ঘোরা এবং কানে শোঁ শোঁ শব্দ হওয়ার মতো সমস্যা গত দশ বছরে দশ গুণ বেড়েছে শুধু হর্নের দাপটে।’’ বছর কয়েক আগে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্যে মূলত মধ্য কলকাতায় হর্নের বাড়াবাড়ি নিয়ে একটি সমীক্ষা হয়েছিল। তাতে যুক্ত ছিলেন দুলালবাবু। জানালেন, এক্সাইড মোড়-সহ বহু জায়গায় হর্নের শব্দ হামেশাই ৮০-৮৫ ডেসিবেল ছাড়িয়ে যায়। সরকারি এক প্রকল্পে কয়েক বছর আগে ট্রাফিক পুলিশদের শারীরিক অবস্থা নিয়ে সমীক্ষা হয়। তাতেও দুলালবাবু যোগ দেন। তখন তাঁরা দেখেছিলেন, বেশির ভাগ ট্রাফিক পুলিশই কানের সমস্যায় ভুগছেন।

আর এক বিশিষ্ট চিকিৎসক শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতায়, এখন কলকাতায় মানুষের থেকে যেন গাড়ি বেশি আর কলকাতার লোক হর্ন ছাড়া গাড়ি চালাতে জানেন না। তাঁর আফশোস, ‘‘গাড়ি চালানো শেখানোর সময়ে এখানে হর্নের পরিমিত ব্যবহার শেখানোর চল-ই নেই। ফলে সচেতনতা তৈরি হয় না। তার উপরে নেই শাস্তির কড়াকড়ি। ফলে হর্নের জন্য ‘ক্রকনিক নয়েজ ট্রমা’য় কান নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি রক্তচাপ ও হার্ট রেট বৃদ্ধি, রাতে ঘুম না-হওয়ার মতো সমস্যা হয়।

চিকিৎসক দীপঙ্কর দত্ত আবার বলছিলেন, ‘‘মাসে যত বধিরতার কেস পাচ্ছি, তার ২৫-২৭ শতাংশই হর্নের কারণে। বিশেষত, কলকাতায় অল্পবয়সে বধিরতার অন্যতম কারণ শব্দদূষণ।’’ চিকিৎসক শঙ্করপ্রসাদ বেরার মতে, ‘‘প্রতিদিন হাসপাতালে অন্তত দু’জন রোগী আসছেন, যাঁদের কানের ‘ইনার মেমব্রেন’ তীব্র হর্নে ফেটে গিয়েছে।’’

অনিয়ন্ত্রিত হর্নে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যায় পড়েন হৃদ্‌রোগী এবং হাইপারটেনশনে আক্রান্তরাও। মানসিক অস্থিরতা-বিরক্তির পারদ চড়তে থাকে অনেকেরই। হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছিলেন, যাঁদের হার্ট দুর্বল, হর্নের বিকট শব্দে তাঁদের ‘সিমটোমেটিক স্টিমুলেশন’ হয়। অর্থাৎ, বুক ধড়ফড় করে, হার্ট রেট বেড়ে যায়। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ কুণাল সরকারের কথায়, ‘‘বিশেষত রাতের দিকে চার দিক নিস্তব্ধ হলে লরি, বাস বিশেষত দূরপাল্লার বাসের হর্নে রাস্তার ধারের হাসপাতালে ভর্তি হৃদ্‌রোগীরা আরও অসুস্থ বোধ করেন।’’

শুধু শরীরে নয়, বিকট হর্ন প্রভাব ফলে মানুষের মনেও। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রাম আবার বলেছেন, ‘‘লাগাতার হর্নের শব্দে বিরক্তি ও অশান্তির মাত্রা বাড়ে। অনেকে খিটখিটে হয়ে যান, ধৈর্য হারিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েন।’’ মনোবিদদের মতে, বিষয়টা অনেকটা দুষ্টচক্রের মতো। গাড়ির চালকেরা আশপাশের প্রচণ্ড হর্নের শব্দে তিতিবিরক্ত হয়ে নিজেরা বেশি করে, অপ্রয়োজনে হর্ন বাজিয়ে ফেলেন। মনের বিরক্তি তাঁরা অনেক সময়ে এ ভাবে প্রকাশ করেন।

রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন ল’ অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় জানান, বছর পাঁচেক আগে একটা সমীক্ষা চালায় রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের শব্দদূষণ নজরদারি কমিটি। টানা চার মাস যে সব লরিচালকেরা মোটর ভেহিক্‌লস-এ লাইসেন্স পুনর্নবীকরণের জন্য এসেছিলেন, তাঁদের শ্রবণক্ষমতার উপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছিল ১০ জনের মধ্যে চার জন চালকই আংশিক ভাবে শ্রবণক্ষমতা হারিয়েছেন এবং তার জন্য প্রধানত দায়ী লাগাতার হর্নের আওয়াজ।

হর্নের এত ক্ষতিকর দিক থাকা সত্ত্বেও কেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসছে না রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ?

Parijat Bandyopadhyay People doctor Hospital
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy