গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।
মানসিক রোগ নিয়ে আগের চেয়ে সচেতনতা কিছুটা বেড়েছে। প্রতিদিন সমাজের ব্যবহারিক বৈষম্য কী ভাবে কুরে কুরে খায় মানসিক রোগগ্রস্ত মানুষদের, তা নিয়েও চলেছে লাগাতার প্রচার, লেখালেখি। কিন্তু স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের একাংশই যে এখনও সেই বৈষম্য থেকে মুক্ত হতে পারেননি, জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলন সেটাই আরও এক বার বেআব্রু করে দিল।
নিরাপত্তার দাবিতে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল রাজ্যের অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজেও। কিন্তু রোগীদের ভোগান্তির প্রশ্নে যে সব মানুষ তাঁদের পাশে দাঁড়াননি, অথবা সমালোচনা করেছেন, তাঁদের কপালে জুটেছে ‘মানসিক রোগগ্রস্ত’ অথবা ‘পাগল’ তকমা। এমনকি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কেও এ হেন পোস্ট হু হু করে শেয়ার হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। চিকিৎসক থেকে তাঁদের পরিবার-বন্ধুবান্ধব বা শুভানুধ্যায়ী— বাদ যাননি প্রায় কেউই।
বিরুদ্ধ পক্ষকে প্রকাশ্যে হেনস্থা করার লক্ষ্যেই এমন মন্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় করা হচ্ছে বলে মনে করেন মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায়। তিনি জানান, শিক্ষিত সমাজের এমন মন্তব্যের জেরে ভুগতে হচ্ছে মনোরোগীদেরই। তাঁর কথায়, ‘‘কারও ব্যবহার পছন্দ হচ্ছে না মানেই তাঁকে পাগল বলে দেগে দিলাম। সমাজও তাঁকে পাগল ছাপ মেরে দিল। এর পরে সেই ব্যক্তি ন্যায্য কারণে কোনও কথা বলতে গেলে তাঁকে পাগল বলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।’’ সমাজকর্মী রত্নাবলী রায় মনে করছেন, বিরোধীদের জব্দ করতে ‘পাগল’ শব্দের ব্যবহার রাজনীতিতে ধারাবাহিক ভাবে চলে আসছে এবং তা মান্যতা পেয়েছে। আজ তারই পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাঁর কথায়, ‘‘পাগল শব্দটি রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার হচ্ছে। এতে থাকছে অবমাননা এবং অসত্য প্রমাণ করার চতুর রাজনীতি। পাগল বলে দেগে গিয়ে সমাজের চোখে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’’ আর তার ফল ভুগছেন মনোরোগীরা। মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কলঙ্কের জের যাঁদের বয়ে বেড়াতে হয় জীবনভর, এ যেন তাঁদের আবার নতুন করে অসম্মান করা।
আরও পড়ুন: বাংলার গুরুত্ব, লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা অধীর
রত্নাবলীর ব্যাখ্যায়, ‘‘এর সব চেয়ে বড় প্রভাব হল, মনোরোগীরা সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেলেও তাঁদের সেই অবমাননার লেন্স দিয়েই দেখা হবে। শিক্ষিত মানুষজনই এমন মানসিকতা দেখাতে থাকলে ভুক্তভোগীদের প্রতি বৈষম্য কোনও দিনই শেষ হবে না।’’
শুধু চিকিৎসকেরাই নন, অপরের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে পরিহাস করার এই প্রবণতা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যেই সমান ভাবে রয়েছে বলে মনে করছেন মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম। তাঁর কথায়, ‘‘মতের মিল না হলেই পাগল বলে প্রমাণের চেষ্টা হচ্ছে। অবস্থা এমনই যে, কাউকে কিছু বলা যাবে না। তা হলেই অপর জন হেয় করার চেষ্টা করবে। তাই উপায়, কোনও রকম প্ররোচনাতেই পা না দিয়ে চুপ থাকা।’’
তবে শুধুমাত্র পাগল বলার মধ্যে অবশ্য ‘খুব একটা দোষের’ কিছু দেখছেন না পরিচালক অনীক দত্ত। চিকিৎসক আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে সম্প্রতি এনআরএসে গিয়েছিলেন তিনি। সাফ বলছেন, ‘‘শালীনতার মাত্রা অতিক্রম করাকে সমর্থন করি না। আমি নিজেও তা করি না। তবে যা সত্যি, তা বলার মধ্যে কোনও দোষ দেখি না। উন্মাদের মতো ব্যবহার করছে— এ কথা বলার মধ্যে কোনও নোংরামো নেই। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত জীবনকে টেনে এনে কদর্য মন্তব্য যদি করা হয়, সেটা অবমাননাকর। তবে উনি নিজেই কিন্তু এর আগে অনেক কদর্য ভাষায় অন্যকে আক্রমণ করেছেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy