Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

শপিং মলের সঙ্গে টক্করেই জীবনযুদ্ধের শিক্ষা ফুটপাতে

ধর্মতলার ফুটপাতে মহম্মদ সামসাদ দিলখোলা লোক! গলা নামিয়ে নিজের বিপণন-কৌশলের তুকতাক খুলে বলছেন— ‘‘এই জ্যাকেটটা ৩২০ টাকায় কিনেছি। আমাকে কিন্তু একটু বাড়িয়ে দাম বলতেই হবে! ৬০০-৭০০ না চাইলে অন্তত ৪০০-৪৫০ হাতে থাকে কি, বলুন?’’

ধর্মতলার ফুটপাতে। নিজস্ব চিত্র

ধর্মতলার ফুটপাতে। নিজস্ব চিত্র

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:০৭
Share: Save:

ঘড়ি হোক বা টি-শার্ট, জুতো হোক বা রোদচশমা! কলকাতার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ‘এটা কত’ বলে দাম জিজ্ঞেস করতে গিয়েছেন তো আপনি মরেছেন!

বাড়তি আত্মবিশ্বাস না-থাকলে ফুটপাতে বাজার আপনার জন্য নয়। দৃঢ় ভাবে দাম হেঁকে বরং প্রত্যয়ে স্থিত থাকুন! ‘প্রতিপক্ষ’ হকার ভাইয়ের কোর্টেই ঠেলে দিন যুদ্ধটা। না হলে মুশকিল।

ধর্মতলার ফুটপাতে মহম্মদ সামসাদ দিলখোলা লোক! গলা নামিয়ে নিজের বিপণন-কৌশলের তুকতাক খুলে বলছেন— ‘‘এই জ্যাকেটটা ৩২০ টাকায় কিনেছি। আমাকে কিন্তু একটু বাড়িয়ে দাম বলতেই হবে! ৬০০-৭০০ না চাইলে অন্তত ৪০০-৪৫০ হাতে থাকে কি, বলুন?’’

লেনিন সরণিতে তিন প্রজন্মের পুরনো ব্যাগের দোকানের বাইরেও হাতলবিশিষ্ট, চাকাওয়ালা ব্যাগের পসরা ফুটপাতে। ফুটপাতের বিক্রেতা ৭০০ টাকা দাম হাঁকলেন। ভিতরে একই চেহারার ব্যাগের দাম দু’চার হাজার! হকার দাদাকে কঠিন মুখে ‘৪০০-র বেশি এক পয়সা দেব না’ বলতেই তিনি সজোরে দু’দিকে ঘাড় নাড়লেন! কিন্তু ওই তল্লাট ছেড়ে প্রস্থানে উদ্যত হতেই প্রশ্ন, ‘আরে দাদা, আ-হা বলুনই না, কত ভাবলেন!’ শেষটা কাকুতি-মিনতি, ‘আর ৫০টা টাকা না-হয় বেশি দিলেন!’ একটু বাদে ব্যাগের দোকানের তরুণ কর্তা দানিশ মালিক শোনালেন, ফুটপাতে সব লোকাল কারখানার মাল। তাঁর দাবি, ‘‘সস্তার ব্যাগ বোঝাই করে বেরোতে গেলেই কিন্তু হ্যান্ডেল বেঁকে যেতে পারে, কিংবা চাকা হয়তো উল্টো দিকে ঘুরে গেল।’’

শহর জুড়ে দাপুটে হকার-রাজ তবু নির্বিকল্প! নৈহাটি থেকে আসা একাদশ শ্রেণির দুই সদ্য ‘লায়েক’ হওয়া বন্ধু যেমন সোমবারই গড়িয়াহাটে ঘুরতে এসেছেন। বিধ্বংসী আগুনে ধ্বস্ত মোড়ের অদূরে দাঁড়িয়ে অমিত চৌধুরী, অশোক চৌধুরীরা সোয়েটার আর ১০০ টাকায় কালো চশমা কিনলেন। দোকানদারের হাতে সবুজ ফ্রেমের চিলতে চৌখুপি আয়নায় রোদচশমার ‘লুক টেস্ট’! সদ্য যুবার অনাবিল হাসিতে ভরপুর শীতের দুপুর। বিকেলে স্থানীয় হকার ইউনিয়নের নেতা অজিত সাহা ট্রেডার্স অ্যাসেম্বলি-র উল্টো দিকের ফুটপাতে নিজের ব্যাগের পসরা নিয়ে দাঁড়িয়ে। হেসে বললেন, ‘‘জীবন কিন্তু থেমে নেই! আগুন লাগার ধাক্কা সামলে সবাই ফের পুরোদমে লেগে পড়েছি।’’

একেলে ঝকঝকে শপিং মল যদি শহরের প্রসাধনের চিহ্ন হয়ে ওঠে, আলাদা প্রাণের স্পর্শ ফুটপাতের ধারেই। গড়িয়াহাট পাড়া তথা কলকাতা ১৯-এর বাসিন্দা তপতী মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘ফুটপাতের ডালা থেকে বারবার আগুন লাগার খবর শুনে দুশ্চিন্তা হচ্ছে। কিন্তু ঝকঝকে শপিং মল নিয়েও আমরা কি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত?’’ ইংরেজি কেতা রপ্ত করে শপিং মলের ছেলেমেয়েদের প্রাণপণে ‘ম্যাডাম ম্যাডাম’ ডাকে হাসিই পায় তপতীর। ফুটপাতের ডালার সামনে হকারদের বড়দা-দিদিভাই-বৌদি ডাকের ঘরোয়া ‘সেল্‌সম্যানশিপ’ বরং ঢের মজাদার। আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাসিন্দা শতভিষা চট্টোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতা, ‘‘দুপুরে বাঙালি ব্যবসায়ীদের শাড়ির দোকানে এখনও একটু ঘুম ঘুম আবহ থাকে! সেই তুলনায় শপিং মল বা ফুটপাত কিন্তু সজাগ।’’

নতুন যুগের কেনাকাটা তা হলে কোন মন্ত্রে টিকে থাকবে? হিন্দুস্থান পার্কে তাঁতের শাড়ির বিশেষজ্ঞ বিপণি বছর আটেক হল নানা ধরনের হস্তশিল্প সামগ্রী মেলে ধরছে। কেনাকাটার পাশাপাশি সুচিন্তিত মুখরোচক কাফেরও আয়োজন। ফুটপাতের দরাদরি সংলাপ না-থাকলেও সোশ্যাল মিডিয়া-নির্ভর প্রচারে ভর করেই সেখানে নতুন করে ক্রেতা-বিক্রেতার সংলাপ দানা বাঁধছে।

তবে বিলেতের কিংবদন্তীপ্রতিম সব বিপণির ধাঁচে কলকাতার অনেক সম্পন্ন খুচরো ব্যবসায়ীর পুরনো দোকানই যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে এক ছাঁচে ঢালা কেনাকাটার সামগ্রী নিয়ে অভিযোগ থাকলেও স্বাচ্ছন্দ্যের জোরেই টিকে আছে শপিং মল। ধর্মতলার ব্যাগের দোকানের দানিশ মালিক দুঃখ করছিলেন, ‘‘এখন লগনের টাইম (বিয়ের মরসুম)। তবু দোকানে ভিড় নেই। অনলাইন কেনাকাটার যুগে আমরা মার খাচ্ছি। শপিং মলের থেকে আমাদের বেশি ভ্যারাইটি, তবু ভিড়টা ও দিকেই বেশি!’’ শহরের সাবেক বিপণিতে দুর্যোগের আবহে কলকাতায় যুগ পরিবর্তনের একটা সঙ্কেতও কিন্তু উঠে আসছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Shopping Shopping Mall Dharmatala Gariahat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE