Advertisement
E-Paper

নিয়ম ভেঙে যথেচ্ছ বিদ্যুতের সংযোগ, পিজি তাই জতুগৃহ

আগুন লাগার পরে অনেকেই এখন বলছেন, এসএসকেএম হাসপাতাল জতুগৃহ তো হয়েই রয়েছে। সামান্য ফুলকিতেই তা দাউদাউ করে জ্বলে উঠতে পারে যে কোনও দিন।

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৩১
এসএসকেএমে স্তূপীকৃত দাহ্য বস্তু। মঙ্গলবার। — নিজস্ব চিত্র

এসএসকেএমে স্তূপীকৃত দাহ্য বস্তু। মঙ্গলবার। — নিজস্ব চিত্র

আগুন লাগার পরে অনেকেই এখন বলছেন, এসএসকেএম হাসপাতাল জতুগৃহ তো হয়েই রয়েছে। সামান্য ফুলকিতেই তা দাউদাউ করে জ্বলে উঠতে পারে যে কোনও দিন।

যাঁরা বলছেন, তাঁদের একটা বড় অংশই চিকিৎসক। এ ছাড়া রয়েছেন হাসপাতালের নার্স এবং পূর্ত বিভাগের কর্মীরাও। সোমবারের অগ্নিকাণ্ডের পরে সেই জতুগৃহ–দশা থেকে বেরোনোর চেষ্টা শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, সবাই সব জানা সত্ত্বেও এত দিন কেন এ ভাবে বিপজ্জনক অবস্থায় থেকে যেতে পারল রাজ্যের সেরা সরকারি হাসপাতাল? হাসপাতালের কর্তারা বা পূর্ত বিভাগের কর্মীরা কি যথাযথ নজরদারি চালাননি? নাকি সব জেনেও তাঁরা চুপ করেই ছিলেন?

হাসপাতালের সুপার করবী বড়াল এ প্রশ্নের সবিস্তার উত্তর দিতে চাননি। শুধু বলেছেন, ‘‘রোগী এবং হাসপাতালের সমস্ত চিকিৎসক-অচিকিৎসক কর্মীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমাদের। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এতগুলো মানুষের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করছি না, এটুকু শুধু বলতে পারি।’’ পূর্ত বিভাগের কর্মীরা জানান, নজরদারির দায়িত্ব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষেরও। কোথায়, কোথায় অনিয়ম চলছে তা তাঁরা একাধিক বার হাসপাতাল কর্তাদের জানিয়েছেন। কিন্তু কেউ সে কথা কানে তোলেননি।

ঠিক কী ভাবে জতুগৃহ হয়ে রয়েছে এসএসকেএম? চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এমবিবিএস, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট পড়ুয়াদের হস্টেলে বেশ কিছু ‘প্রভাবশালী’ পড়ুয়ার ঘরে নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে পূর্ত দফতরের কর্মীদের নজর এড়িয়ে একাধিক বাড়তি বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা রয়েছে। কোথাও ঘরে হিটার জ্বলছে। কোথাও চলছে এসি। আবার কোথাও বা শৌচাগারে গিজার বসিয়ে নিয়েছেন কেউ। কোথাও আবার হস্টেলের ঘরকেই নিজের ব্যক্তিগত ঘরের মতো সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে সেখানে ফ্রিজ ঢোকানো হয়েছে। বিদ্যুতের লাইনের ধারণ-ক্ষমতাকে ছাপিয়ে এ ভাবেই অবাধে বাড়তি বিদ্যুৎ ব্যবহার চলছে এসএসকেএমের এমবিবিএস পডুয়া এবং জুনিয়র ডাক্তারদের হস্টেলে।

এই ‘প্রভাবশালী’ পড়ুয়ারা কারা? হাসপাতালের অন্দরে কথা বলে জানা গিয়েছে, এঁদের মধ্যে শাসক দলের ঘনিষ্ঠরা যেমন আছেন, তেমনই আছেন স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের ঘনিষ্ঠরাও। আছেন প্রাক্তন জনপ্রতিনিধির স্নেহধন্যরাও।

কর্তারা স্বীকার করেছেন, বহু চেষ্টা করেও হস্টেলগুলিতে এই মৌরসিপাট্টা তাঁরা ভাঙতে পারছেন না। হাসপাতালের এক কর্তার কথায়, ‘‘একাধিক বার হিটারের লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে। এসি-গুলিও অকেজো করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু দিন কয়েক যেতে না যেতেই ফের সব আগের জায়গায় ফিরে এসেছে। বাধা দিলে নানা ধরনের আন্দোলনের হুমকি আসে। আমরাও খুব বেশি জোর খাটাতে চাই না। কারণ পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে সমস্যা মিটবে না।’’

সোমবার রোনাল্ড রস বিল্ডিং-এ আগুন লাগার পরে হাসপাতালের সমস্ত স্তরের কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। হাসপাতালের কর্মীরা বলছেন, এমবিবিএস হস্টেল, পিজিটি হস্টেল, রোনাল্ড রস বিল্ডিং-এর ছাদে যথেচ্ছ নির্মাণ হয়েছে। ছাদে অ্যাসবেস্টস-এর শেড করে ও তার নীচে ফলস্ সিলিং লাগানো হয়েছে। এই সিলিংগুলি খুবই বিপজ্জনক। যে কোনও সময় ভেঙে পড়তে পারে। আগুন লাগলে তা দ্রুত ছড়ানোর ক্ষেত্রে এর ভূমিকা হবে মারাত্মক।

হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে হাসপাতালের নানা ধরনের সংস্কারে হাত দিয়েছেন তিনি। হাত দিয়েছেন হাসপাতালকে দালালমুক্ত করার কাজেও। ডাক্তারদের একটা অংশ অরূপবাবুর কাছেও অনুরোধ জানিয়েছেন, জতুগৃহের চেহারা থেকে মুক্তি দেওয়া হোক এই হাসপাতালকে। মেডিসিন বিভাগের এক প্রবীণ চিকিৎসক বলেন, ‘‘পড়ুয়াদের হস্টেল জতুগৃহ হয়ে রয়েছে। জতুগৃহ হয়ে রয়েছে ম্যাকেঞ্জি ব্লকও। ওই ব্লকের নীচে গ্যাসের উনুন জ্বেলে রান্না চলে। সেখানে শিশু বিভাগ, সার্জারি বিভাগ, মেডিসিন বিভাগ রয়েছে। আগুন লাগলে কী হবে কেউ জানে না। ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে হাসপাতালের সেন্ট্রাল কিচেনে আগুন লেগেছিল। তার পরেও কোনও শিক্ষা নেয়নি কেউ।’’ গত চার বছরে ১২ বার আগুন লেগেছে এই হাসপাতালে। এর মধ্যে গত ছ’মাসে চার বার। চার বারই শর্ট সার্কিট হয়েছে। কিন্তু তার পরেও হুঁশ ফেরেনি কারও। চিকিৎসকদের বক্তব্য, বার বার হুঁশিয়ারি মিলছে নানা ভাবে। তবু যদি কর্তৃপক্ষের সম্বিৎ না ফেরে তা হলে যে কোনও দিন আরও বড় কোনও বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। তখন হয়তো সামলানোর ফুরসতটুকুও পাওয়া যাবে না।

আমরি-কাণ্ডের পরে রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলিতে ফায়ার সেফটি অফিসার নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। স্থির হয়, নির্দিষ্ট সময় অন্তর ফায়ার ড্রিল হবে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি। এখনও বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের যত্রতত্র ডাঁই করে রাখা থাকে আবর্জনা। ইতস্তত ঝোলে বিদ্যুতের তার। বাইরে থেকে নানা রূপটানের ব্যবস্থা হলেও ভিতরটা রয়েছে আগের মতোই বিপজ্জনক। বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজ সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল। ফের দেখাল এসএসকেএম।

SSKM Electricity Connection
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy