Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
বিপন্ন কৈশোর

চেনা গণ্ডিতেই নিগ্রহ, বলছে সমীক্ষা

স্কুলবাসে সবশেষে বাড়িতে নামানো হতো তাকে। নামানোর আগে ফাঁকা বাসে নিত্যদিন গাড়ির চালক ও খালাসির হাতে নিগৃহীতা হতো ক্লাস এইটের মেয়েটি। কয়েক মাস এ ভাবে চলার পরে এক দিন বাড়িতে সব জানায় সে। আগে কেন জানায়নি?

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৬ ০১:০২
Share: Save:

স্কুলবাসে সবশেষে বাড়িতে নামানো হতো তাকে। নামানোর আগে ফাঁকা বাসে নিত্যদিন গাড়ির চালক ও খালাসির হাতে নিগৃহীতা হতো ক্লাস এইটের মেয়েটি। কয়েক মাস এ ভাবে চলার পরে এক দিন বাড়িতে সব জানায় সে। আগে কেন জানায়নি? কারণ, তাকে শাসানো হয়েছিল জানালে প্রাণে মেরে ফেলা হবে।

বছর কয়েক আগে কলকাতার এই সাড়া ফেলে দেওয়া ঘটনা বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের নানা বিপন্নতার কথা সামনে এনেছিল। অতি সম্প্রতি মনোরোগ সংক্রান্ত এক আন্তর্জাতিক জার্নালে কলকাতার স্কুলপড়ুয়াদের মানসিক সমস্যা নিয়ে এমনই কিছু তথ্য সামনে এসেছে। যে সমস্যার অধিকাংশের নেপথ্যেই রয়েছে নানা ভাবে শারীরিক অত্যাচার। সমীক্ষক দলে আছেন পুদুচেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত মনস্তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক শিবনাথ দেব, কানাডার লাভাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃণালকান্তি রায়, কলকাতার এক বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বহ্নিশিখা ভট্টাচার্য এবং অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির অধ্যাপক জিয়ানডং সান। কলকাতার ছ’টি ইংরেজি মাধ্যম হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের ১৩-১৮ বছর বয়সী পড়ুয়াদের উপরে করা ওই সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছে এশিয়ান জার্নাল অব সাইকিয়াট্রি-তে।

কী রয়েছে সমীক্ষায়?

জানা গিয়েছে, ২৫ শতাংশ পড়ুয়া নিয়মিত নানা শারীরিক অত্যাচারের শিকার। আর ১৩ শতাংশ পড়ুয়া সরাসরি যৌন নিগ্রহের শিকার। ওই সব নির্যাতন নষ্ট করেছে তাদের আত্মবিশ্বাস। চিড় ধরিয়েছে সারল্য, সততা আর মূল্যবোধে। বাড়িয়েছে উদ্বেগ, হতাশা। সব মিলিয়ে ৫২.৪ শতাংশ পড়ুয়া কোনও না কোনও মানসিক সমস্যায় ভুগছে।

সমীক্ষক দলের প্রধান শিবনাথ দেব বলেন, ‘‘অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের মানুষ হিসেবেই ধরা হয় না। তারা অন্যের উপরে সামাজিক ও আর্থিক ভাবে নির্ভরশীল, তাই চাপ দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ রাখা সহজ। এ কারণেই ঘরে-বাইরে অবদমিত যৌন লালসার শিকারও হয় তারা।’’ আর এ থেকেই দাগ থেকে যায় তাদের কিশোর মনে। ভবিষ্যতের পক্ষে যা হয়ে উঠতে পারে মারাত্মক। শিবনাথবাবুর কথায়, ‘‘আমরা যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের মধ্যে ৬১ শতাংশ অন্তত এক বার কোনও না কোনও হিংসার শিকার হয়েছে। এই ক্ষতে প্রলেপ না পড়লে তাদের পরবর্তী জীবন নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’’

এ শহরের মনোবিদেরাও মনে করেন, এই সমীক্ষা ঠিক তথ্যই তুলে এনেছে। তাঁদের মতে, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা যথেষ্ট সচেতন ও সংবেদনশীল না হলে পরিণতি হতে পারে মারাত্মক। মনোবিদ মোহিত রণদীপের মতে, চারপাশে কী ঘটছে সে সম্পর্কে বাবা-মায়েদের আরও সচেতন হওয়া দরকার। ছেলেমেয়েদেরও ওয়াকিবহাল করাটাও তাঁদের কর্তব্য। তিনি বলেন, ‘‘ছোট থেকেই শেখাতে হবে ‘গুড টাচ’ আর ব্যাড টাচ’-এর পার্থক্য। শেখাতে হবে কী ভাবে তারা প্রয়োজনে ‘না’ বলবে।’’

স্কুলের দায়িত্বও অনেক। মোহিতবাবুর অভিজ্ঞতায়, অনেক স্কুলই নানা ধরনের হিংসার কথা জেনেও চুপ করে থাকে। কেউ কথা বলতে চাইলেও স্কুলের সুনামের কথা ভেবে তাকে চুপ করিয়ে রাখতে চায়। এই প্রবণতাও কম বিপজ্জনক নয়। স্কুলের দারোয়ান, বাসের চালক, বাড়ির পরিচারক, এমনকী বাবার বন্ধু— অনেকের দ্বারাই যৌন নিগ্রহের কথা স্বীকার করেছে পড়ুয়ারা। এখানেই শেষ নয়। উঁচু ক্লাসের পড়ুয়ারা নিচু ক্লাসের পড়ুয়াদের উপরে নিগ্রহ চালিয়েছে, এমন নজিরও অনেক।

মনোরোগ চিকিৎসক জ্যোতির্ময় সমাজদার বলেন, ‘‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তথাকথিত কাছের মানুষের থেকেই এমন ঘটনা ঘটায় মা-বাবাকেও সেটা বলতে পারেনি আক্রান্ত। আর তাই সেটা ভিতরে আরও বেশি করে চেপে বসেছে। আলাদা ভাবে পরপর ক’দিন তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারলে হয়তো সেটা বার করে আনা সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হল, আমাদের সামাজিক গঠনটাই এমন যে, ডাক্তারের চেম্বারে মা-বাবাই বেশি কথা বলতে থাকেন, ছেলেমেয়েকে বলার সুযোগ দেন না।’’

জ্যোতির্ময়বাবু জানিয়েছেন, তাঁরা এমন অনেক স্কুলপড়ুয়াকে পান, যাদের হয়তো ঘন ঘন ফিট হয়ে যাচ্ছে। কিংবা পড়াশোনায় ভাল, হাসিখুশি কোনও ছেলে বা মেয়ে আচমকা গুটিয়ে থাকছে। সব সময়ে মনমরা দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন বাবা-মা। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, বেশ কিছু ক্ষেত্রে গোপন শারীরিক নিগ্রহই এর জন্য দায়ী।

কলকাতার একটি স্কুলের অধ্যক্ষ সুপ্রিয় ধর জানান, তাঁদের মেয়েদের স্কুলটিতে নিয়মিত কর্মশালা করে এই ধরনের সমস্যা সামলানোর ব্যাপারে ছাত্রীদের সচেতন করেন শিক্ষক ও কাউন্সেলাররা। তিনি বলেন, ‘‘যে কথা মেয়েরা বাবা-মাকেও বলতে পারে না, সে কথা অনেক সময়ে কাউন্সেলারদের কাছে বলতে পারে।’’ তাঁদের ছেলেদের স্কুলে এ ধরনের কর্মশালার ব্যবস্থা নেই। কেন? সুপ্রিয়বাবুর কথায়, ‘‘এখনও প্রয়োজন পড়েনি।’’ যদিও ছেলেদের অন্য একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক পরেশ নন্দ জানান, তাঁরা নিয়মিত আলোচনাচক্রের আয়োজন করেন। তাঁর কথায়, ‘‘বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে কী ভাবে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে, তা নানা ভাবে ছাত্রদের শেখানোর চেষ্টা করি।’’

সমীক্ষকেরা তো বটেই, মনোবিদেরাও জানাচ্ছেন, কিশোরীদের পাশাপাশি তাঁদের চেম্বারে যৌন নিগ্রহের শিকার কিশোরদের ভিড়ও কিছু কম নয়। সহপাঠী, উঁচু ক্লাসের দাদা বা আত্মীয়দের দ্বারা লাঞ্ছিত হলেও বহু সময়ে তারা বলতে পারে না। তাই মনোবিদদের পরামর্শ, ছেলেদের ক্ষেত্রেও স্কুলে তো বটেই বাড়িতেও অভিভাবকদের সতর্ক থাকা দরকার। ফুটে ওঠার আগে শৈশব-কৈশোর যেন ঝরে না যায়, তা দেখার দায়িত্ব সকলেরই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE