৭২ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধের কিনারা করা হবে। অপরাধীদের গ্রেফতার করা হবে। সৎকারের জন্য নিয়ে যাওয়ার সময়ে নিউ টাউনে ধর্ষিত ও নিহত নাবালিকার মৃতদেহ ঘিরে বিক্ষোভ শান্ত করতে শুক্রবার এমনই আশ্বাস দিয়েছিল বিধাননগর পুলিশ। কিন্তু অপরাধের কিনারা করা তো দূর, দেহ উদ্ধারের পরে ৩৬ ঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও শনিবার রাত পর্যন্ত কাউকেই ধরতে পারেনি পুলিশ। মেলেনি এই ঘটনা ঘিরে তৈরি হওয়া একাধিক প্রশ্নের সদুত্তরও। যে কারণে মৃতার পরিজনেরা এ দিন প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘কেন পুলিশ এখনও কাউকে ধরতে পারল না? কেন আমরা কোনও কিছুরই উত্তর পাচ্ছি না? তার জবাব কে দেবে?’’ পুলিশের যদিও দাবি, ‘‘বেশ কিছু সূত্র হাতে এসেছে। খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দ্রুত ঘটনার কিনারা হবে।’’ এ দিন উত্তর ২৪ পরগনায় মৃতার বাড়িতে গেলে তার বাবা বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমাদের আবেদন, যারা মেয়ের উপরে এই পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে ধর্ষণ ও খুন করেছে, তাদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়া হোক।’’
শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ নিউ টাউনের লোহাপুলের কাছে জঙ্গলে ঘেরা একটি পরিত্যক্ত জমি থেকে অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া এক কিশোরীর মৃতদেহ উদ্ধার হয়। ময়না তদন্তে খুন এবং ধর্ষণের বিষয়টি উঠে আসে। পুলিশি ঘেরাটোপের মধ্যে মৃতার মা দাবি করেন, মেয়ের সারা শরীরে তিনি আঁচড়ের দাগ দেখেছেন। বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর বকুনি খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল মেয়ে। সারা রাত খোঁজাখুঁজির পরে ভোরে পুলিশে নিখোঁজ ডায়েরি করেন তাঁরা। শুক্রবার সকালে পাওয়া যায় কিশোরীর দেহ। কিন্তু সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে জঙ্গলে ঘেরা পরিত্যক্ত ওই জায়গায় গেল কী করে, সেই প্রশ্ন ওঠে। রহস্য ভেদ করতে এ দিন সকাল থেকে নিউ টাউন থানায় বসে ঘটনাস্থল এবং মৃতার বাড়ি সংলগ্ন একাধিক রাস্তার সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা শুরু করে পুলিশ। আগাগোড়া সেখানে ছিলেন বিধাননগরের নগরপাল শ্রীমুকেশ এবং ডিসি (নিউ টাউন) মানব সিংলা। বিকেল ৪টে নাগাদ নিউ টাউন থানা থেকে বেরিয়ে যান তাঁরা।
সূত্রের খবর, সিসিটিভি ফুটেজে জগৎপুরের কাছে এক জায়গায় পুলিশ তিনটি মোটরবাইক চিহ্নিত করেছে। তার একটিতে এক কিশোরীকে উঠে যেতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু বাইকে ওঠা সেই কিশোরীই মৃতা নাবালিকা কিনা, তা নিশ্চিত ভাবে বোঝা যায়নি এ দিন। একটি সূত্রের দাবি, যে বাইকগুলি দেখা গিয়েছে, সেগুলির নম্বরও স্পষ্ট হয়নি তদন্তকারীদের কাছে। পুলিশের অন্দরের খবর, এ জন্য দায়ী নিউ টাউন এলাকার ক্যামেরার মান এবং বেশ কিছু জায়গায় ক্যামেরা বিকল হয়ে থাকার বিষয়টি। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ খতিয়ে দেখার পাশাপাশি, যেখান থেকে দেহ উদ্ধার করা হয়েছিল, সেখানে পুলিশ কুকুর নিয়ে যাওয়া হয় এ দিন ভোরে। সেই সূত্রে কিছু তথ্য হাতে এসেছে বলে পুলিশ সূত্রের খবর। কিন্তু মৃতার নিম্নাঙ্গের পোশাক এ দিনও মেলেনি বলে জানা গিয়েছে। এ দিন সকালে দেহ উদ্ধারের জায়গায় পুলিশ পিকেট বসিয়ে দেওয়া হয়েছে বিধাননগর পুলিশের তরফে।
এ দিন ওই জায়গায় পৌঁছে দেখা যায়, খালের ধারে অনেকটা জায়গা জুড়ে বিচ্ছিন্ন একটি জমি। উঁচু লোহার জাল দিয়ে ঘেরা। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, নীচের যে অংশে জাল ভাঙা, সেখান থেকে প্রায় ৪০ মিটার দূরে পড়ে ছিল মৃতদেহটি। তাঁরা জানাচ্ছেন, ওই জায়গাটি না চিনলে সেখানে পৌঁছনো সহজ নয়। ওই কিশোরী সেখানে কী ভাবে গেল, সেটাই রহস্য। তার বাবা এ দিন বলেছেন, ‘‘মেয়ের বাইকে ওঠার যে কথা বলা হচ্ছে, তা আমরা মানতে পারছি না। পাড়ায় কয়েক জন মেয়ে বন্ধু ছিল ওর। সাইকেলে করে মেয়ে স্কুলে যেত। এর বাইরে কারও বাইকে চড়ে কোথাও যাওয়ার ব্যাপারই নেই।’’ পরিবার সূত্রে দাবি, অতীতে কয়েক বার রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কেষ্টপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিল কিশোরী। পরিবারের ধারণা, বৃহস্পতিবার রাতেও হয়তো সেই আত্মীয়ের বাড়িতেই যাচ্ছিল সে। জগৎপুরের কাছে সেই কারণেই তাকে দেখা গিয়ে থাকতে পারে। এক আত্মীয়ের কথায়, ‘‘ওর কাছে টাকাপয়সা ছিল না। পৌঁছে দেওয়ার নাম করেও কেউ ওকে বাইকে তুলে নিয়ে থাকতে পারে। সবটাই ধোঁয়াশা। স্পষ্ট বলতে পারছে না পুলিশও।’’
কী করে এমনটা ঘটল, জানতে চেয়ে এবং দোষীদের শাস্তির দাবিতে শুক্রবার গভীর রাত পর্যন্ত নাবালিকার দেহ ঘিরে বিক্ষোভ চলে। পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দিতে গেলে কিনারা কত ক্ষণে হবে, সেই সময় চান বিক্ষোভকারীরা। তত ক্ষণে মৃতার বাবা মুম্বই থেকে এসে পৌঁছন। পুলিশ ৭২ ঘণ্টা সময় চেয়ে নিলে দেহ নিয়ে মৃতার পরিবার উত্তর ২৪ পরগনায় যায়। সেখানেই এ দিন সকালে তার শেষকৃত্য হয়েছে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)