Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সমাবেশে পঙ্গু শহর সামলাতে দিশাহারা পুলিশ

শনিবারের বারবেলায় ধর্মতলা পেরোতে যাচ্ছিলেন যাঁরা, ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি, এক মিছিল ও সমাবেশের ঠেলায় তাঁদের নাকের ডগায় হঠাত্‌ অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে মহানগরের প্রাণকেন্দ্র। যার ধাক্কায় উত্তর ও দক্ষিণে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অচল হয়ে পড়বে শহর। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথে আটকে থাকতে হবে মানুষকে। এবং ঢিলেঢালা ভাব ছেড়ে অনেক পরে পরিস্থিতি সামলাতে নেমে সমাবেশে আসা জনতার তাড়া খেয়ে অপদস্থ হতে হবে পুলিশকে!

জমিয়তে উলেমায়ে হিন্দের সমাবেশে যোগ দিতে যাচ্ছেন সমর্থকেরা। শনিবার ধর্মতলা চত্বরে শুভাশিস ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

জমিয়তে উলেমায়ে হিন্দের সমাবেশে যোগ দিতে যাচ্ছেন সমর্থকেরা। শনিবার ধর্মতলা চত্বরে শুভাশিস ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৪০
Share: Save:

শনিবারের বারবেলায় ধর্মতলা পেরোতে যাচ্ছিলেন যাঁরা, ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি, এক মিছিল ও সমাবেশের ঠেলায় তাঁদের নাকের ডগায় হঠাত্‌ অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে মহানগরের প্রাণকেন্দ্র। যার ধাক্কায় উত্তর ও দক্ষিণে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অচল হয়ে পড়বে শহর। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথে আটকে থাকতে হবে মানুষকে। এবং ঢিলেঢালা ভাব ছেড়ে অনেক পরে পরিস্থিতি সামলাতে নেমে সমাবেশে আসা জনতার তাড়া খেয়ে অপদস্থ হতে হবে পুলিশকে!

পরিস্থিতি এতটাই হাতের বাইরে চলে যায় যে, বেলা আড়াইটে নাগাদ অনেকেই দেখেন, লালবাজারের চার শীর্ষ কর্তা-সহ এক দল পুলিশ আত্মরক্ষার জন্য ময়দানের একটি ক্লাবের দিকে ছুটছেন। অভিযোগ, ১০-১২ জন পুলিশকর্মী আহত হয়েছেন। এক যুগ্ম কমিশনারের গাড়ি-সহ ১০-১২টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। অনেকেরই বক্তব্য, রাজপথে জনবিস্ফোরণের সামনে শেষটা আত্মসমর্পণ করেই লালবাজারের মুখ পুড়েছে। পুলিশের কাজে বাধাদানের অভিযোগে রাতে মিছিলের সংগঠকদের নামে ময়দান থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয় ঠিকই, কিন্তু কেউ গ্রেফতার হননি।

এই সমাবেশের আহ্বায়ক জমিয়তে উলেমায়ে হিন্দ সম্প্রতি বর্ধমান শহরে একটি সভা করেছিল। তার জেরে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সেই শহর। এ দিন তাদের সমাবেশে লাখ খানেক লোক আসতে পারে বলে তারা আগে থেকে জানিয়েছিল। শেষে লোক হয়েছে তার দেড় গুণ। কিন্তু এত লোক সামলানোর মতো ন্যূনতম প্রস্তুতি দেখা যায়নি পুলিশের মধ্যে। এই সভার মূল উদ্যোক্তা যিনি, বছর দুয়েক আগে তাঁর ডাকে অন্য এক সমাবেশে আক্রান্ত হয়েছিলেন লালবাজারের উচ্চপদস্থ এক পুলিশকর্তা। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আগেভাগে সাবধান পর্যন্ত হতে দেখা যায়নি পুলিশকে। অথচ এই পুলিশই ইডেনে ক্রিকেটের আসর বা পুজোর ভিড় সামলায় দীর্ঘদিন ধরে।

এ দিন এমন কেন হল?

পুলিশের তরফে যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র অবশ্য ব্যবস্থাপনার কোনও ত্রুটি মানতে চাননি। তিনি বলেন, “এমন পরিস্থিতি সামলাতে যা যা করা দরকার, সবই আমরা করেছি।” কিন্তু যেখানে পুলিশের পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে এমন ভিড়ের চেহারা-চরিত্র সম্পর্কে, সেখানে তারা আগে থেকে তৈরি ছিল না কেন? এর কোনও সদুত্তর মেলেনি লালবাজারের কর্তাদের কাছ থেকে। লালবাজারে এক কর্তা জানান, প্রায় তিন হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। সঙ্গে ছিলেন এক জন যুগ্ম কমিশনার, ৫ জন ডেপুটি কমিশনার, ৩০ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার পদ মর্যাদার পুলিশ। পুলিশেরই এক সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, লাখ খানেকের বেশি মানুষ এবং হাজার তিনেক গাড়ি আসবে এটা জানা ছিল। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় তত্‌পরতা দেখায়নি পুলিশ। সে কথা মানছেন রাজপথে কর্তব্যরত ট্র্যাফিক অফিসারদের একাংশও। তাঁরা বলছেন, ব্রিগেডে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলোর সমাবেশের দিনে সকাল থেকে পুলিশ নামিয়ে রাজপথ সচল রাখার চেষ্টা করা হয়। এ দিন তা দেখা যায়নি। যদিও লালবাজারের শীর্ষস্তরের এক মহলের দাবি, এমন ভিড়ে কোনও বাহিনীর পক্ষেই কিছু করার থাকে না। তা ছাড়া, মিছিলে দেড় লক্ষের বেশি লোক হবে, তা তাঁরা আঁচই করতে পারেননি!

সন্ত্রাসবাদীর শাস্তি, ইসলাম ধর্ম ও মাদ্রাসার ভাবমূর্তি হনন, দেশপ্রেম ও ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিতে জমিয়তে উলেমায়ে হিন্দের সমাবেশের জন্য রাস্তায় ভিড় বাড়তে শুরু করেছিল এগারোটার পর থেকেই। হাওড়া, শিয়ালদহ স্টেশন, কলকাতার চার-পাঁচটি জায়গা ছাড়াও শহরে শ’য়ে শ’য়ে ম্যাটাডোর ঢুকতে শুরু করে। ফলে বেলা বারোটার পর পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়।

সেটা কেমন, তা হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছেন সন্তোষপুরের শ্রাবন্তী ঘোষ। পার্ক স্ট্রিটে কাজ সেরে সাড়ে বারোটা নাগাদ জওহরলাল নেহরু রোড ধরে চাঁদনি চক এলাকায় অফিস যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। মিছিলের জন্য পুলিশের নির্দেশে প্রথমে তাঁকে দক্ষিণ দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে হয়। এর পরে এক্সাইডের মোড় অবধি গিয়ে ভিক্টোরিয়া, ময়দানের পাশ দিয়ে ফের উত্তর কলকাতার দিকে যেতে গিয়ে কার্যত চক্রব্যূহে বন্দি হন তিনি। কখনও রেড রোড দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করেছেন, কখনও বাবুঘাট লাগোয়া রাস্তা দিয়ে। ঘণ্টা দুয়েক পরে সেই এক্সাইড মোড়েই ফিরে আসেন। তার পরে অগত্যা, গাড়ি ছেড়ে মেট্রোই ভরসা। ওই মহিলা চাঁদনি চকে পৌঁছেছেন বিকেল তিনটেয়!

শিয়ালদহ থেকে এলগিন রোড যেতে ঘণ্টা দুয়েক সময় লেগেছে বাংলার এক তরুণ ক্রিকেটারেরও। এলগিন রোড থেকে ইডেনে প্র্যাকটিসে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। শেষটায় হাল ছেড়ে দিয়ে ফেসবুকে বিরক্তিভরা মন্তব্য করেন ওই তরুণ।

বেলা দু’টোর পার্ক স্ট্রিট। দীর্ঘ ক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলির মধ্যেই একটি অ্যাম্বুল্যান্স। তাতে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন এক প্রৌঢ়া। তাঁরা হাওড়ার মুন্সিরহাটের বাসিন্দা। মহিলার ছেলে শেখ মুজিবর রহমান জানালেন, হাওড়া থেকে তাঁর অসুস্থ মাকে নিয়ে মেডিক্যাল কলেজে যাচ্ছিলেন। কিন্তু রাস্তাতেই তিনি ঘণ্টাখানেক আটকে রয়েছেন। স্ট্র্যান্ড রোডের পরিস্থিতিও তথৈবচ। রাস্তায় আলাদা লেনের অস্তিত্ব কার্যত ছিল না। পর্যাপ্ত পুলিশও ছিল না পরিস্থিতি সামলাতে। বেশ কিছু ক্ষণ বাদে ক’জন সেনা জওয়ান পথে নামেন। এই পরিস্থিতির ভুক্তভোগী বেসরকারি সংস্থার কর্মী কুণাল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বাবুঘাট থেকে হেস্টিংস পৌঁছতে ঝাড়া এক ঘণ্টা লেগেছে।” এস এন ব্যানার্জি রোড, জওহরলাল নেহরু রোড, মেয়ো রোড, ডাফরিন রোড, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের মতো রাস্তাগুলোর ছবিও ছিল একই রকম। উত্তরের আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড, বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট থেকে শুরু করে বিবাদী বাগ এলাকা বা দক্ষিণের আশুতোষ মুখার্জি রোড, ডিএল খান রোড, খিদিরপুর রোড, খিদিরপুর লাগোয়া ডায়মন্ড হারবার রোডের গতি ছিল পুরোপুরি রুদ্ধ। যানজটের প্রভাব পড়েছে প্রত্যন্ত দক্ষিণে তারাতলা-বেহালাতেও।

পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশ অবশ্য একটিই পরিকল্পনা নিয়েছিল। রেড রোডে দক্ষিণ থেকে উত্তরে মিছিল ঢুকতে দেয়নি। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হয়নি। অন্য রাস্তাগুলোয় বিশৃঙ্খলার মধ্যে মিছিলকারীরা ম্যাটাডর-ট্রাকে বা পায়ে হেঁটে রেড রোডেও ঢুকতে থাকে। মুশকিল হল, এ বার অবস্থা সামলাতে পুলিশের কোনও দ্বিতীয় পরিকল্পনা ছিল না। ফলে, মুহূর্তে ভেঙে পড়ল ওখানকার ট্র্যাফিক ব্যবস্থাও।

একটা সময়ে দেখা গিয়েছে, রাস্তার গার্ডরেল ফেলে দিয়ে জনতার তাণ্ডব চলছে। কিন্তু পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকায়। এই সময়েই পরিস্থিতি সামলাতে যুগ্ম কমিশনার (ইন্টেলিজেন্স) দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়ি ঢুকছিল রেড রোডে। তখন বেলা সওয়া দু’টো। মিছিলের গাড়ি আটকে কেন পুলিশ নিজেরা গাড়ি নিয়ে ঢুকছে এই নিয়ে গোলমাল বেধে যায়। কয়েক জন শীর্ষস্তরের কর্তা খবর পেয়ে এসেও অশান্তি থামাতে পারেননি। শীর্ষস্তরের অফিসার-সহ কয়েক জন পুলিশকর্মী ইটের ঘায়ে আহত হয়েছেন বলে অভিযোগ। পুলিশকর্তারা ঝামেলা এড়াতে কোনও মতে ডালহৌসি ক্লাবের ভিতরে ঢুকে পড়েন। র্যাফ ও কম্যান্ডো পুলিশ নামাতে হয় রাস্তায়।

ময়দান থানায় সরকারি কর্মীদের মারধর, বাধাদান ও গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে জমিয়তে উলেমায়ে হিন্দের নেতা সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী-সহ মিছিলের সংগঠকদের নামে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। সিদ্দিকুল্লা সাহেব অবশ্য এমন পরিস্থিতির জন্য পুলিশ তথা রাজ্য সরকারকেই দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, “পুলিশকে মিছিলের বিষয়ে সবিস্তার আগেই জানানো হয়েছিল। তা ছাড়া, আমরা ব্রিগেডে সভা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রাজ্য সরকার তা দেয়নি।” আগামী শীতে তিনি ফের ব্রিগেডে সভা করবেন বলে জানিয়েছেন। পুলিশ অবশ্য ব্রিগেডে সভার অনুমতির বিষয়টি সেনাবাহিনীর এক্তিয়ারভুক্ত বলে দাবি করেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE