Advertisement
E-Paper

জীর্ণ দেহে তাপ্পি, ফিরে আসে চাকা

পার্ক সার্কাসের একটি স্কুলের সামনে সার দিয়ে দাঁড়ানো স্কুলগাড়ি। কয়েকটির চাকা এতটাই পুরনো যে, একেবারে মসৃণ হয়ে গিয়েছে। নিজেদের বাচ্চাদের ওই সব স্কুলগাড়ির দায়িত্বে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে রয়েছেন অভিভাবকেরাও।

সুপ্রিয় তরফদার

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৬ ০০:১৮

চিত্র ১: পার্ক সার্কাসের একটি স্কুলের সামনে সার দিয়ে দাঁড়ানো স্কুলগাড়ি। কয়েকটির চাকা এতটাই পুরনো যে, একেবারে মসৃণ হয়ে গিয়েছে। নিজেদের বাচ্চাদের ওই সব স্কুলগাড়ির দায়িত্বে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে রয়েছেন অভিভাবকেরাও।

চিত্র ২: মধ্য কলকাতার এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পড়ুয়ারা যে সব গাড়িতে যাতায়াত করে, তার মধ্যে বেশ কয়েকটির চাকা ‘রিসোলিং’ করা বা তাপ্পি দেওয়া। স্কুলের সামনে গিয়ে দেখা গেল, কয়েকটি গাড়ির ক্ষেত্রে সেই তাপ্পিও উঠে গিয়েছে।

চিত্র ৩: রবীন্দ্র সদনের একটি মেয়েদের স্কুলেও এক ছবি। স্কুলবাসের চাকা প্রায় সমান হয়ে গিয়েছে।

এবড়ো-খেবড়ো আর মসৃণের মধ্যে মানুষ সব সময়েই বেছে নেয় মসৃণ পথ। কিন্তু গাড়ির চাকা যদি মসৃণ হয়ে যায়, তা হলে চলার পথ আর মসৃণ থাকে না। নিয়ম বলছে, গাড়ির চাকায় খাঁজ কাটা অংশ থাকা বাধ্যতামূলক। কারণ ব্রেক কষার পরে ওই অংশই গাড়িকে থামতে সাহায্য করে। গাড়ি যাতে কার্যত রাস্তার সঙ্গে মাটি কামড়ে চলতে পারে, সে জন্যই এই ব্যবস্থা। কিন্তু চাকা মসৃণ হয়ে গেলে ব্রেক কষার সঙ্গে সঙ্গে তা দাঁড়াতে পারে না, পিছলে যায়, ঠিক যেটা ঘটেছিল গত শুক্রবার, তপসিয়ায়। স্কুলবাসের চাকা মসৃণ হয়ে যাওয়ায় সে দিন ব্রেক কষেও দাঁড় করানো যায়নি ওই বাসটিকে। সেটি সোজা গিয়ে ধাক্কা মারে সামনের সেতুর স্তম্ভে। যাতে মৃত্যু হয় চালকের।

তাতেও হুঁশ ফেরেনি স্কুলবাসগুলির। মসৃণ হয়ে যাওয়া বা বেআইনি ভাবে ‘রিসোল’ করা চাকা নিয়ে দিব্যি চলছে স্কুলবাস ও গাড়ি।

‘রিসোল’ করা চাকা থাকা সত্ত্বেও কী ভাবে ফিটনেস সার্টিফিকেট পাচ্ছে এই সব গাড়ি ও বাস? জানা গিয়েছে, বছরে এক বার করে প্রতিটি স্কুলবাস ও স্কুলগাড়ির ফিটনেস বা স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়। যে দিন পরীক্ষা থাকে, সে দিন গাড়িতে প্রায় নতুন চাকা লাগিয়ে নিয়ে আসা হয়। এই সব নতুন চাকা ভাড়া পাওয়া যায় বাজারে। এক দিনের জন্য তা ভাড়া নিয়ে চলে আসেন গাড়ির চালক বা মালিক। সহজেই জুটে যায় ফিটনেস সার্টিফিকেট।

পরিবহণ দফতরের অধীনে রয়েছে মোটর ভেহিক্‌লস বিভাগ (পিভিডি)। যে গাড়ি রাস্তায় চলছে, তার স্বাস্থ্য ঠিক আছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব এই বিভাগের। পরিবহণ দফতরের এক কর্তা জানান, চাকায় তাপ্পি দেওয়া থাকলে কখনওই ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া হয় না। তবে একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমরাও জানি, সার্টিফিকেট নেওয়ার সময়ে ভাল চাকা লাগানো থাকলেও পরে তা খুলে ফেলা হয়। এক বার সার্টিফিকেট পেয়ে গেলে ভাল চাকা সরিয়ে রেখে ফের তাপ্পি দেওয়া চাকা লাগিয়েই গাড়ি চলে।’’

তাঁদের কি কিছুই করার নেই? ওই কর্তা জানান, এই জালিয়াতি আটকানোর জন্য দফতরের এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ রয়েছে। রাস্তায় নেমে গাড়ি পরীক্ষা করার কথা সেই শাখার অফিসারদের। সূত্রের খবর, সেই শাখায় লোকবল এতই কম যে, রাস্তায় নেমে নজরদারি চালানো কার্যত অসম্ভব। সেই ফাঁক গলেই বেরিয়ে যাচ্ছেন স্কুলবাস ও স্কুলগাড়ির চালকেরা। পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর, বিভিন্ন দোকানে গাড়ির চাকা রিসোলিং করা হয়। এ বিষয়ে তাদের কিছু করার নেই। একমাত্র ট্রাফিক পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে।

তপসিয়ার ওই দুর্ঘটনার পরে কলকাতা ট্রাফিক পুলিশের তরফে নজরদারি চালানো হবে বলে জানিয়েছিলেন ডিসি (ট্রাফিক) ভি সলোমন নেসাকুমার। কিন্তু চাকা রিসোলিং করার ‘রোগ’ তো বহু দিনের। এত দিন পুলি‌শ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি কেন? নেসাকুমারকে বারবার ফোন এবং এসএমএস করা হলেও তিনি কোনও উত্তর দেননি।

প্রশ্ন উঠেছে অভিভাবক এবং স্কুল-কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়েও। যে অভিভাবকেরা তাঁর সন্তানদের বাস বা স্কুলগাড়িতে পাঠান, তাঁরা কি আদৌ গাড়ির চাকার অবস্থা খতিয়ে দেখেন? তা দেখে কোনও ব্যবস্থা নেন?

দায় রয়েছে স্কুলগুলিরও। গোখেল মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের অধ্যক্ষ ইন্দ্রাণী মিত্র বলেন, ‘‘আমাদের নিজস্ব কোনও বাস নেই। তাই সেগুলির অবস্থা নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না।’’ কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী, স্কুলের নিজস্ব বাস না থাকলেও মালিকের সঙ্গে স্কুল যে চুক্তি করে, সেখানেও তো স্কুল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব থেকে যায়। কারণ তাঁদের পড়ুয়ারাই তো ওই বাসে ওঠে। মন্তব্য করতে চাননি ইন্দ্রাণীদেবী।

পাঠভবনের প্রধান শিক্ষিকা সান্ত্বনা রায় বলেন, ‘‘আমাদের নিজেদের বাসে কোনও সমস্যা নেই।’’ তবে, চুক্তির ভিত্তিতে অন্য কাউকে দিয়ে বাস চালানো হলে সেই বাসের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার দায়ও যে স্কুল কর্তৃপক্ষের উপরে বর্তায়, তা মেনে নিয়েছেন সান্ত্বনাদেবী।

স্কুলবাসগুলির সংগঠন ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল কন্ট্র্যাক্টচুয়াল ক্যারেজ ওনার অ্যান্ড অপারেটর্স’-এর সভাপতি হিমাদ্রি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সামনের চাকায় তাপ্পি দেওয়া রয়েছে, এমন কোনও গাড়ি আমাদের সংগঠনের নেই। তারা কোনও ভাবেই আমাদের সঙ্গে যুক্ত নয়। তবে পিছনের চাকার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা থাকে। কিন্তু তার ফলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কম।’’

ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

vehicles poor daily distress
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy