এই পাড়ার বিশিষ্ট পরিচয় দু’টি বাৎসরিক আয়োজন। ‘সিংহি পার্ক সর্বজনীন দুর্গোৎসব’ এবং ‘ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মেলন’। আমাদের পাড়ার এই সঙ্গীত সম্মেলনটি এখন সারা দেশে এবং ভারতের বাইরেও পরিচিতি লাভ করেছে।
এই অনুষ্ঠান দু’টি এত বছর ধরে করা সম্ভব হওয়ার একমাত্র কারণ, ডোভার লেন এখনও পাড়া স্পিরিটটা ধরে রাখতে পেরেছে। কলকাতার আর কোনও পাড়ায় হয় কিনা জানি না, আমাদের এখানে পুজোর তিন দিনই পাড়া প্রতিবেশীদের পঙ্ক্তিভোজন বহু দিন ধরেই হয়ে আসছে। ডোভার লেন পাড়া বলতে অবশ্য শুধু এই রাস্তাটি নয়। আশেপাশের নন্দী স্ট্রিট, ডোভার টেরাস, হিন্দুস্থান রোড, ডোভার প্লেস— সব ক’টি রাস্তা নিয়েই আমাদের পাড়া। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি গোটা অঞ্চলের ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনার সঙ্গে খেলাধুলো করে বড় হচ্ছে। এঁরাই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে পুজো এবং সঙ্গীত সম্মেলনের গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব নিচ্ছেন।
এই ব্যাপারটাই এই পাড়ার মেজাজ। এই পাড়ার বেশির ভাগই সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। এঁদের মধ্যে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষজন আছেন। অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, ডাক্তার, আইনবিদ, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও খেলোয়াড়। এ পাড়ার স্থাপত্যেরও একটা বৈশিষ্ট্য আছে। বেশির ভাগ বাড়ি দোতলা। আর প্রায় সব বাড়িতেই আছে বারান্দা। অবশ্য এখন বহু বাড়ি ভেঙে বহুতল হচ্ছে। সেটাই তো সার্বিক ভাবে কলকাতার বর্তমান চেহারা।
এক সময়ে এই এলাকার অনেকটা জমি ছিল সিংহিদের। আর ছিল প্রোমোটার ট্যালবট কোম্পানি-র জমি। সেই জমিই প্লট করে বিক্রি হয়েছে। এই এলাকায় যেমন বিভিন্ন বিশিষ্ট বাঙালিদের বাড়ি ছিল অথবা এখনও আছে, অনেক অবাঙালিও থাকেন এখানে। একটা কথা মনে পড়ছে, একেবারে বাল্যকালের কথা। পাড়ার বোথরাদের বাড়িতে গানের জলসা বসত। ভিতরের ঘেরা চত্বরে ছিল আসর। মেয়েরা বসতেন দোতলার ঘেরা বারান্দায় আর সকলে বসতেন চত্বরের চারপাশে। বলতে গেলে আমাদের পাড়ায় সঙ্গীত চর্চার আবহ সেই ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি। গোড়ায় ডোভার লেনের সঙ্গীতের আসরও পাড়ার মাঠেই হয়েছে।
তখন বেশ কিছু মাঠ ছিল এ পাড়ায়। সবচেয়ে বড় মাঠ ছিল ‘সিংহি পার্ক’। এখানে এক সময়ে কলকাতার ময়দান কাঁপানো ফুটবল খেলোয়াড়রা ‘সিংহি চ্যালেঞ্জ শিল্ড’ জেতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তেন। এখন পুরো মাঠটাই ভরে গিয়েছে বহুতলে। পাড়ায় মাঠ আর নেই। আমরা ছেলেবেলায় পাড়ার মাঠেই খেলেছি। এখনকার ছেলে-মেয়েদের জন্য তাই কষ্ট হয়। আর একটি বাড়ি ছিল বিপিনবিহারী ঘোষের। সেই বাড়ির চৌহদ্দিতে ছিল বিশাল মাঠ, পুকুর। মাঠে খেলাধুলো আর পুকুরে সাঁতার কাটা ছিল নিত্য দিনের ব্যাপার। এখানেই ছিল এককালের নামকরা স্কাউট দল, ‘অশোক গ্রুপ’।
পাড়াকেন্দ্রিক হয়েই ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মেলনের জন্ম। তার গল্পটাও খুব মজার। সে সময়ে খুব পাড়ায় পাড়ায় ‘লড়াই’ ছিল। এ পাড়ার ছেলেরা ও পাড়ার পুজো বেশি ভাল হয়ে গেলে চিন্তায় পড়ত। আমার দাদারা তখন যুবক। এঁরাই পুজোর ব্যবস্থাপনায় এগিয়ে যেতেন। হঠাৎ দেখা গেল, হিন্দুস্থান পার্কের দিকে কোনও এক জায়গায় জমজমাট জলসা হচ্ছে। এদের টেক্কা দিতেই পুজোর গায়ে গায়ে আয়োজন করে ফেলা হল ডোভার লেনের প্রথম সঙ্গীত সম্মেলনের। বেশ জনপ্রিয় হল। দু’-তিন বছরের মধ্যে এই জলসাই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসরে পরিণত হল। এত বছর ধরে বিশিষ্ট শিল্পীদের কাছ থেকে সমাদর পেয়ে এসেছে ‘ডোভার লেন’। এমনও হয়েছে কোনও বার কোনও শিল্পীকে আমন্ত্রণ না জানানো হলে তিনি অভিমান করতেন।
তার পরে আবারও আমন্ত্রণ জানালে তিনি আসতেনই। ডোভার লেনের সেই আদি যুগে একটি আসরে কিংবদন্তি আলাউদ্দীন খানের সঙ্গে একই মঞ্চে বাজিয়েছিলেন আলি আকবর খান, রবিশঙ্কর ও আশিস খান। মনে পড়ছে, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর কথা। আমাদের পাড়ায় তিনি তাস খেলতে আসতেন বন্ধুর বাড়িতে। মাঝেমাঝে সেখানে বসে তিনি এসরাজ বাজাতেন। এই সংস্কৃতির মধ্যেই বড় হয়েছি এই পাড়ায়। সত্যজিৎ রায়কেও সামনাসামনি দেখা প্রথম এই পাড়ায়। এক সময়ে ডোভার লেনের আসরে তিনি ছিলেন নিয়মিত শ্রোতা। আমরা ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মেলনের পরিচালনায় এসেছি সেই পাড়া স্পিরিটকেই সম্বল করে। বাজার করতে করতেও আমরা তার প্রস্তুতির আলোচনায় মেতে থাকি। কোন বার কোন শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানানো হবে, তা নিয়ে পাড়ার বাজারে মাছ কিনতে কিনতে হয়ত শুরু হল বাদানুবাদ। তাতে কী?
আমাদের পাড়ার সংস্কৃতিটাও অনেকটা উত্তর কলকাতার পাড়াগুলোর মতোই। একটু মিলেমিশে থাকার অভ্যাস সকলেরই। এখনও সকাল-সন্ধ্যা পাড়ার মোড়ে আড্ডায় মাততে দেখা যায় ১৮ থেকে ৮০-র অনেককেই। তবে ছোটবেলায় যে ভাবে পাড়া সংস্কৃতি বজায় রাখা হত, এখন তো গোটা কলকাতার কোথাও ততটা নেই। এখানেও কমেছে। আমদের পরের প্রজন্মের অনেকেই আর পাড়ার পিছনে সময় দিতে পারে না। তবে এখনও পুরনো বাসিন্দা অনেকেই আছেন। পাড়ার ব্যাপারে তাঁদের এখনও এগিয়ে আসতে দেখা যায়।
কালের নিয়মে এখন পাড়ার ভিতরে হইচই কমে গিয়েছে। মেলামেশাও খানিকটা স্তিমিত।
তাই নিরাপত্তার দিকটা এখন খানিকটা ভাবায়। আর একটি নিয়মিত সমস্যা আছে। জল। জলের চাপ এখানে কমই থাকে। এ ব্যাপারগুলো প্রশাসনের নজরে পড়লে ভাল হয়। আর পাড়ার মধ্যেই তো সব সময়ে আবদ্ধ থাকা যায় না। কাজেকর্মে মানুষজনকে বেরোতেই হয়। কিন্তু পাড়ার গণ্ডির ধারেই হকার সমস্যা। খুবই জাগ্রত।
তবে এই সমস্যাগুলো এই জায়গার প্রতি আমাদের ভালবাসার নিরিখে তেমন বড় নয়। এই আমি, আমার ৬ বছর বয়স থেকে এ পাড়ার বাসিন্দা। সমবয়সী কয়েক জন এখনও সজীব আছেন। পুরাতন ও বর্তমান নিয়ে আমাদের ডোভার লেনের পাড়া পাড়া মেজাজটা এখনও মজিয়ে রেখেছে আমাদের সকলকে।
লেখক প্রবীণ সাংবাদিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy