Advertisement
E-Paper

‘দাদা, জেলের মধ্যে সব সেটিং আছে’

জানতে না পারার এই ধারা বহাল আলিপুর জেলেও। প্রেসিডেন্সির অবস্থাও তথৈবচ। শুধু নিয়মকানুনের একটু অদল-বদল, এই যা!

সৌরভ দত্ত

শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৮ ১৪:০৭
অপেক্ষা: আলিপুর সংশোধনাগারের বাইরে বন্দিদের পরিজনদের ভিড়। নিজস্ব চিত্র

অপেক্ষা: আলিপুর সংশোধনাগারের বাইরে বন্দিদের পরিজনদের ভিড়। নিজস্ব চিত্র

সকাল ১০টা। দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের ফটক লাগোয়া লোহার গ্রিলের ভিতরে ইটের টুকরোর তলায় বন্দিদের পরিজনদের পরিচয়পত্রের ফোটোকপি হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে। সেপাই নাম ডাকা শুরু করা মাত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জমায়েত গ্রিলের মুখে এসে জড়ো হল। সকলের হাতে খাবার-সহ ব্যাগ ভর্তি জিনিস। সে দিকে তাকিয়ে বিড়িতে টান দিতে দিতে সদ্য জেল খেটে বেরিয়ে আসা যুবক বলে উঠলেন, ‘‘দাদা, জেলের মধ্যে সব সেটিং রয়েছে। আপনারা বাইরে থেকে বুঝতে পারেন না!’’

জানতে না পারার এই ধারা বহাল আলিপুর জেলেও। প্রেসিডেন্সির অবস্থাও তথৈবচ। শুধু নিয়মকানুনের একটু অদল-বদল, এই যা! পরিজনদের সঙ্গে আলাপচারিতার সময় যত গড়াল, ‘সেটিং’-এর অর্থ ক্রমশ খোলসা হল। দমদমে যিনি এই শব্দের অর্থ বোঝালেন, বাগুইআটি এলাকার সেই বাসিন্দা সম্প্রতি চুরির অভিযোগে সংশোধনাগারে গিয়েছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘নামেই সংশোধনাগার। জেলে আসলে টাকা কথা বলে।’’ দ্রুত সংশোধনী এনে বললেন, ‘‘টাকা মানে কুপন। দশ দিন ছিলাম। মা ১১ হাজার টাকা জমা করেছিল। যার কাছে যত কুপন, জেলে তার কদর তত বেশি।’’ মাঝবয়সী স্বাস্থ্যবান যুবকের মুখের কথা কেড়ে নিলেন ধানবাদের বাসিন্দা। মাস ছয়েক আগে মাদক পাচারের অভিযোগে নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো (এনসিবি) নিউ টাউন থেকে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে। তাঁদেরই এক জনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন ধানবাদনিবাসী। বললেন, ‘‘আমার বন্ধুর পরিবারের অবস্থা ভাল। ছেলে যাতে ভাল থাকে, তার জন্য সপ্তাহে সাড়ে তিন হাজার টাকা দেয়।’’ আলিপুরে এই বক্তব্যই শোনা গেল জামাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে আসা প্রৌঢ়ার গলায়। বললেন, ‘‘এখানে টাকা ছাড়া কোনও কথা নেই বাবা। বেশি ক্ষণ কথা বলতে
হলেও ৫০ টাকা ঘুষ লাগে। আগে ২০ টাকা ছিল।’’

বাইরে থাকার চেয়ে জেলে থাকার খরচ কি বেশি? ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে কারণ ব্যাখ্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তেঘরিয়ার বাসিন্দা আর এক বন্দির পরিজন। তাঁর দাবি, জেলের খাবার মুখে দেওয়া যায় না। কুপনের বিনিময়ে ক্যান্টিনের খাবার সস্তায় পুষ্টিকর। বড় কাতলা মাছের পিস ৪০ টাকা। ডিম, দু’পিস আলু, ঝোল ১৫ টাকা। ছ’পিস খাসির মাংসের প্লেটের দাম ৮০ টাকা। চায়ের কাপে ফুঁ দিয়ে তাঁর সংযোজন, ‘‘জেলের ভিতরে দামি হল নেশা! ২০ টাকার যে গাঁজার পুরিয়া আছে, ওটা জেলে ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়। চিমটি করে এটুকু দিচ্ছে, তারই দাম ৩০ টাকা! সিগারেট ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। পাঁচ টাকার খৈনির প্যাকেটের দাম ৪০ টাকা। বিড়ির প্যাকেট ৩০ টাকা।’’ আলিপুর সংশোধনাগার চত্বরে দাঁড়িয়ে ফলতা থেকে ভাইয়ের জন্য আসা দাদার উপলব্ধি, ‘‘গাঁজা, মদ কি ভিতরে চলে না? টাকা থাকলে সব আছে। সব রকম মানে বুঝছেন তো!’’

আরও পড়ুন: বিরক্ত হয়ে মেয়র-মামলা ছেড়ে দিচ্ছেন বিচারক!

নেশার জিনিস বিক্রি হয়? প্রশ্ন শুনে ততোধিক তাচ্ছিল্যে বসিরহাটের বাসিন্দা এক বন্দির পরিজনের মন্তব্য, ‘‘আমরা যখন ইন্টারভিউ দিতে আসি, তখন জিনিসপত্র দিই তো। প্রতি বার ১০ প্যাকেট করে সিগারেটের প্যাকেট দেওয়ার পারমিশন আছে। এ বার যেমন সাত প্যাকেট সিগারেট আর তিন প্যাকেট বিড়ি এনেছি। সবটাই কি আমার লোক খাবে? এর থেকে কিছুটা বিক্রি করবে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টপাটপ কুপন চালাচালি হয়ে যাচ্ছে।’’

আর এই কুপনের লেনদেন নিশ্চিত করছে মোবাইলের ব্যবহার। পরিজনদের দাবি, সংশোধনাগারের ভিতরে তিন ভাবে মোবাইলের ব্যবহার চলে। তাঁদের কথায়, ‘‘জেলের ভিতরে কমবেশি সাড়ে তিন হাজার টাকায় মোবাইল কিনতে পাওয়া যায়। বেরোনোর আগে তা বিক্রি করে দেন বন্দিরা। যাঁদের মোবাইল কেনার সামর্থ্য নেই, তাঁরা অন্যের মোবাইলে কথা বলেন। এক মিনিট কথা বললে পাঁচ টাকা। ভিডিও কল প্রতি মিনিটে ১৫ টাকা।’’ কিন্তু মোবাইল জেলের ভিতরে ঢোকে কী করে? প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললেন বসিরহাটের বছর পঁচিশের তরুণী। তাঁর কথায়, ‘‘জেলে সিম পাওয়া যায় ৩০০ টাকায়। চার্জারের দাম ৪০০ টাকা। জিভের তলায় সিম লুকিয়ে রাখে। জেলের ভিতরে ফোন কিনলে দাম বেশি। তাই আমি কোর্টের দিন পুলিশের হাত দিয়েই মোবাইল পাঠালাম।
আমার কাছ থেকে তার জন্য ৪০০ টাকা নিল।’’

আরও কিছু প্রশ্ন ছিল। কিন্তু অঝোর বর্ষণে উত্তরদাতারা ছত্রখান হয়ে গেলেন। কিন্তু এই জমায়েতে উত্তরদাতার অভাব নেই। অভিজ্ঞতা তো সকলেরই এক। শুধু মুখগুলো বদলে যাচ্ছে।

আলিপুরে সুন্দরবনের এক বাসিন্দা বলছেন, ‘‘বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলার নানা উপায় আছে। এক, যত টাকার কথা বলবে, সেটা রিচার্জ করে দিতে হবে। কথা বলার কল রেট আছে। শুনেছি, প্রতি মিনিটে ৩০ টাকা নেয়। তবে মোবাইল সাবধানে রাখতে হয়। আর জেলের ফোন জেলেই রেখে আসতে হবে।’’

দমদমে জেল সম্পর্কে শিক্ষানবিশের বিস্ময়ের সীমা নেই দেখে বনগাঁ থেকে আসা বধূর মন্তব্য, ‘‘এই যে নেশার জিনিস যারা বিক্রি করে, তারা কি সবটাই পায়! বিভিন্ন স্তরে ভাগ আছে। তা নিয়ে মুখ আর না-ই বা খোলালেন।’’ কত টাকা দেওয়া যায়? ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে আসা এক মহিলার জবাব, ‘‘যত তোমার আছে! ১০, ২০, ৩০। আমি তো ছ’হাজার টাকা দিয়ে এলাম।’’

সংশোধনাগারে কি তা হলে টাকা দিলেই সব কিছু মেলে? রাজ্যের কারামন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস বলেন, ‘‘জেলের পরিবেশে যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে। তবে অল্প কয়েক দিন থেকে জেল কী ছিল আর কী হয়েছে, তা বিচারাধীন বন্দিদের পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। বিচারাধীন বন্দিদের যখন আদালতে নিয়ে যাওয়া হয় ও ফিরিয়ে আনা হয়, তখনই নানা রকম জিনিস জেলে ঢোকে। আমরা প্রচুর মোবাইল উদ্ধার করছি। এর সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। জানি না, জেল প্রশাসনের বদনাম করার জন্য ইচ্ছাকৃত ভাবে এই ধরনের অভিযোগ করা হচ্ছে কি না!’’

(চলবে)

Correctional home Alipore Central Correctional Home Presidency jail আলিপুর সংশোধনাগার
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy