Advertisement
E-Paper

সমস্যা আছে, তবু শিকড়ের টান...

এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পণ্যবাহী লরির পার্কিং, গুদাম, হাজারো জিনিস ওঠানো-নামানোর ব্যস্ততা পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলা, পথচলতি মানুষের গঞ্জনা আর অতীতের আভিজাত্য ঘোষণারত সাবেক থাম-খিলান যুক্ত ঔপনিবেশিক স্থাপত্য— এমনই মিশ্র সংস্কৃতি নিয়ে আমার পাড়া দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিট।

রমেন্দ্র মল্লিক

শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:৪০
রমেন্দ্র মল্লিক

রমেন্দ্র মল্লিক

এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পণ্যবাহী লরির পার্কিং, গুদাম, হাজারো জিনিস ওঠানো-নামানোর ব্যস্ততা পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলা, পথচলতি মানুষের গঞ্জনা আর অতীতের আভিজাত্য ঘোষণারত সাবেক থাম-খিলান যুক্ত ঔপনিবেশিক স্থাপত্য— এমনই মিশ্র সংস্কৃতি নিয়ে আমার পাড়া দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিট।

এটাই অতীতের সেই বনেদি বাঙালি পাড়া, যার উল্লেখ মেলে ইতিহাসের পাতায়। এটা যে একটা বাঙালি পাড়া এখন দেখে বোঝে
কার সাধ্য? এ পাড়ায় বাঙালিরাই আজ সংখ্যালঘু।

গণেশ টকিজের মোড় থেকে কিছুটা এগিয়ে পুঁটেকালীর মন্দির পেরিয়ে, কালীকৃষ্ণ ঠাকুর স্ট্রিটের গা ঘেঁষে শুরু হওয়া দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিট যদুলাল মল্লিক রোড
পেরিয়ে ডালপট্টির কাছে মহর্ষি দেবেন্দ্র রোডে গিয়ে মিশেছে। পাশের এলাকাই পাথুরিয়াঘাটা।

পঁচাশি বছর আগে এ পাড়ার বৈষ্ণবদাস মল্লিকের পরিবারে আমার জন্ম। অতীতের প্রাসাদোপম বাড়িগুলির সেই জৌলুস কবেই উধাও হয়েছে। কিছু বাড়ির চেহারাই বদলে গিয়েছে। একে একে বাঙালি বাড়িগুলি হস্তান্তরিত হচ্ছে অবাঙালিদের হাতে। তবু অটুট এ পাড়ায় বাঙালি-অবাঙালির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। মানুষে মানুষে মৌখিক সৌজন্যটুকু আজও বজায় আছে।

অন্য পাড়ার মতো জোরালো আলো এবং পর্যাপ্ত পানীয় জল থাকলেও পরিচ্ছন্নতায় এ পাড়া পিছিয়ে। রোজ নিয়ম করে সকালে জঞ্জাল সাফাই হলেও পরিষ্কার করার পরের মুহূর্ত থেকে শুরু হয় যত্রতত্র জঞ্জাল ফেলা। ভাবতে অবাক লাগে যেখানে দেশ জুড়ে স্বচ্ছতা অভিযানের দামামা বাজছে, সেখানেই উল্টো দিকে হাঁটছে আমাদের এই পাড়াটা। রাস্তার ধারের দেওয়াল পান ও গুটখার পিকের ধারায় রক্তিম হয়ে থাকে। পথের পাশে জমে থাকে উনুনের ছাই, চায়ের ভাঙা ভাঁড় আর আধ-পোড়া সিগারেট-বিড়ির টুকরো। দিনভর লরি আর ম্যাটাডরের পার্কিং-এ রাস্তায় হাঁটাই দায়। একটু অসর্তক হলেই ধাক্কা লেগে যায় দ্রুত গতিতে আসা ভ্যানরিকশা বা মোটরসাইকেলে। যে কোনও সময়ে ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা।

ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য

আজও এ অঞ্চলের সাবেক পুজোগুলি বহু মানুষকে আকৃষ্ট করে। পুজো-পার্বণে ক্যামেরা হাতে দেখা যায় বিদেশিদেরও। তাঁরা প্রবল আগ্রহে ছবি তোলেন পুরনো পাড়ার বাড়ি-ঘর-ঠাকুরদালানের। আগে পুজোর পরে পাড়ায় বিজয়া সম্মিলনী, গানের জলসা, আর স্ক্রিন টাঙিয়ে সিনেমা দেখানো হত। এখন পাড়ার সর্বজনীন পুজোটা ধুমধাম করে হলেও জলসাটা আর হয় না।

কাছেই কালীকৃষ্ণ ঠাকুর স্ট্রিটে রয়েছে প্রসিদ্ধ পুঁটেকালীর মন্দির। বছরভর লেগে থাকে ভক্ত সমাগম। কিছুটা এগিয়ে বৈকুণ্ঠনাথ মন্দির। ওখানেই আগে ছিল কয়লাঘাটার রমানাথ ঠাকুরের বাড়ি। সেটা আজ শুধুই স্মৃতি।

এক কালের অভিজাত পাড়াটার আজকের হতশ্রী চেহারা দেখে কষ্ট হয়। পরিবর্তনটা শুরু হয় বছর চল্লিশ আগে। এর কারণ ভাঙতে থাকা বাঙালি একান্নবর্তী পরিবার এবং আর্থিক সচ্ছলতার অভাব। বেশি ভাড়ার জন্য এ পাড়ার কিছু মানুষ অবাঙালিদের বাড়ি ভাড়া দিতেন। পরে আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল হয়ে ওঠা অবাঙালিরাই সেই বাড়িগুলি কিনে নিলেন। শুরু হয় পাড়ার ভোল বদল। কাছেই বাণিজ্যিক এলাকা বড়বাজার ও পোস্তা। সেই কারণেই বাণিজ্যিক প্রভাব এ পাড়ায় প্রত্যক্ষ ভাবে পড়েছে। আগে যেগুলি ছিল বসতবা়ড়ি, সেগুলি এখন পণ্যদ্রব্যের গুদাম।

আগে চোখে পড়ত পাড়ার রকের আড্ডা। তবে প্রবীণদের চেয়ে অল্প বয়সিদেরই বেশি আড্ডা দিতে দেখা যেত। তার একটা বড় কারণ ছিল বেকারত্ব। এখন ঘণ্টা ভিত্তিক পার্কিং-এর তদারকি এবং গুদামে নথিভুক্তকরণের কাজে কিছু মানুষের অন্নসংস্থানের পথ খুলেছে। তাই বেকারত্ব কিছুটা কমায় সে ভাবে আড্ডাও মারতে আর দেখা যায় না।

নিজেদের গাড়ি রাখতেও এখানে নাজেহাল দশা হয়। এক এক সময় তো নিজের বাড়ির সামনে গাড়ি রাখতেও কেউ কেউ টাকা চেয়ে বসেন! তার উপরে সরু রাস্তায় লরি বা ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকায় যানজটে জেরবার হওয়াটা প্রতি দিনের ব্যাপার। এমনকী এই কারণে সঙ্কীর্ণ রাস্তায় অ্যাম্বুল্যান্স ঠিক মতো ঢুকতে পারে না।

কালীকৃষ্ণ ঠাকুর স্ট্রিট রাস্তাটি একমুখী হওয়ায় যান চলাচলেও সমস্যা হয়। সেখানে নতুন উড়ালপুলটি তৈরি হওয়ায় নীচের এলাকাটি ‌অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে থাকে। ফ্লা উড়ালপুলটির নীচেও রাস্তার দু’ধারে শুধুই পার্কিং।

এ পাড়ার কিছু ভাল দিকও রয়েছে। হাত বাড়ালেই সব কিছু পাওয়া যায়। গভীর রাত পর্যন্ত এলাকা জমজমাট থাকে। ফলে নিরাপত্তা নিয়ে বাড়তি চিন্তা নেই। কাছেই নতুন বাজার। সেখানে ফল সব্জির ভাল জোগান থাকলেও মাছের জোগান কমেছে। কেউ অসুস্থ হলে কাছাকাছি ডাক্তারও পাওয়া যায়।

ছেলেবেলার পাড়াটা ছিল পরিচ্ছন্ন। পুরনো বাড়িগুলিই ছিল এ পাড়াটার শোভা। ভোর হত রাস্তা ধুইয়ে দেওয়ার আওয়াজ আর ভ্যাল্ভ রেডিওর সেই পরিচিত সুরে। তখন রাস্তায় জ্বলত গ্যাসের আলো। বাড়িতেই ছিল দু’টি ঘোড়ার গাড়ি। পাশেই রাজা প্রফুল্লনাথ ঠাকুরের বাড়ি। আমাদের ছাদে উঠলে দেখা যেত তাঁদের বাড়ির ‘হাওয়া মহল’।

এত সমস্যা থাকা সত্ত্বেও কখনও এই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার কথা ভাবিনি। হয়তো আড়াইশো বছরের শিকড়ের টান, আর
পাড়ার দু’পাশে থামওয়ালা বাড়িগুলির হাতছানি আজও মোহিত করে রেখেছে।

লেখক মল্লিক পরিবারের সদস্য

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy