অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ভারতমাতার সেই ছবি।
গলি থেকে রাজপথ— সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে ওঁদের। বিকেল হোক, সন্ধে হোক বা মাঝরাত, পাড়ায় পাড়ায় বেরিয়ে পড়ছেন একদল যুবক। হাতে জাতীয় পতাকা। মুখে স্লোগান: ‘ভারতমাতা কি জয়’। সঙ্গে অশ্লীল ভাষায় দুষছেন প্রতিবেশী দেশকে।
কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী বিস্ফোরণের পরে এমনটাই চলছে শহরের বিভিন্ন এলাকায়। নাগরিকদের অনেকেরই তাই প্রশ্ন—এঁরা কারা?
অধিকাংশ শহরবাসীরই অবশ্য দাবি, এমন দৃশ্য তাঁরা আগে কখনও দেখেননি। বরং যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত ও শহিদ জওয়ানদের শ্রদ্ধা জানাতে নীরবতাই বেছে নিয়েছেন শহরবাসী। জওয়ানদের ছবি বা স্মৃতিসৌধের সামনে মোমবাতি জ্বালিয়ে এবং মৌন মিছিল করে শ্রদ্ধা জানানোটাই ছিল দস্তুর। কিন্তু এখন ‘ভারতমাতা কি জয়’ বলে যে স্লোগান দেওয়া হচ্ছে, তা নিহত জওয়ানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে, না কি কাশ্মীরের যুব সম্প্রদায়ের একাংশকে সমর্থন করার প্রতিবাদে, তা স্পষ্ট নয়। এমনটাই মনে করছেন শহরবাসী।
বঙ্গভঙ্গের সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে কলকাতার রাস্তায় মিছিল করে বেরিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের হাতে রাখি পরিয়েছিলেন। সেই দিনটির কথা স্মরণ করিয়ে ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায় বলেন, ‘‘সে দিন তৈরি হয়েছিল মিলন-বন্ধন। আর এখন তো মিলনে ছেদটাই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’
রাজ্য জুড়ে এমন ‘ছবি’ দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। খাস কলকাতা ও শহরতলিই শুধু নয়, বিভিন্ন জেলাতেও বেরোচ্ছে এ হেন মিছিল। যেমন, রবিবার সন্ধ্যায় যাদবপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে এক ঘণ্টার মধ্যে চারটি মিছিল বেরোয়। প্রতিটি মিছিলেরই মূল বক্তব্য ছিল, ‘দেশদ্রোহীরা ভারত ছাড়ো।’ আবার টালিগঞ্জের নেতাজিনগরে বেরিয়েছিল অ-বাংলাভাষীদের মিছিল। যা দেখে নেতাজিনগরের বাসিন্দারাও প্রশ্ন তুলেছেন, ‘এঁরা আসলে কারা?’ কারণ, ওই এলাকায় অ-বাংলাভাষীদের বসবাস খুবই কম। ‘তা হলে কি এঁরা বহিরাগত?’ এই প্রশ্নও ঘুরপাক খেয়েছে নেতাজিনগরের বাসিন্দাদের মধ্যে।
আরও পড়ুন: পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার চার দিন পরে হত জইশের শীর্ষ নেতা কামরান
ভারতে জঙ্গি হামলা নিয়ে এই বিষয়গুলো জানেন?
আবার বেহালায় রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ দেখা গিয়েছে, সাত-আটটি মোটরবাইকে চেপে জনা কুড়ি-বাইশ যুবক তীব্র গতিতে যাওয়ার সময়ে চিৎকার করে স্লোগান দিচ্ছেন, ‘ভারতমাতা কি জয়’। রবিবার দুপুরে আনন্দপুরে প্রায় ১০০ জনের মিছিলেও উঠে এসেছে এই ছবি। এমন মিছিল দেখা যাচ্ছে শহরতলি ও জেলার পথেও। সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্রের মতে, কাশ্মীরের ওই হামলার ঘটনাকে সামনে রেখে অসভ্যতা চালিয়ে যাচ্ছেন একদল মানুষ। তিনি বলেন, ‘‘এত জন জওয়ান জঙ্গি হানায় শেষ হয়ে গেলেন! আর এঁরা সেই ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে এই সব করছেন।’’
১৯০৫ সালে স্বদেশি আন্দোলনে বাংলা তখন উত্তাল। সেই সময়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গমাতার ছবি এঁকেছিলেন। তার দু’বছর পরে যখন পঞ্জাব ও মাদ্রাজেও স্বদেশি আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল, তখন তিনি সেই ছবির নাম দেন ‘ভারতমাতা’। রজতবাবু বলেন, ‘‘অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিটি ছিল, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উপরে। যার সঙ্গে এখনকার হিন্দু জাতীয়তাবাদের কোনও মিল নেই। যে পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ ‘জনগণমন’, বঙ্কিমচন্দ্র ‘বন্দে মাতরম’ বা মহম্মদ ইকবাল ‘সারে জঁহা সে আচ্ছা’ লিখেছিলেন, তার সঙ্গে আজকের পরিস্থিতির মিল নেই।’’
সমাজতত্ত্বের শিক্ষক আন্দ্রে বেতেই মনে করেন, যাঁরা স্লোগান দেন, তাঁরা যে সবটা ভেবে বা বুঝে দিচ্ছেন, তেমনটা তো নয়। ‘ভারতমাতা কি জয়’ বললে যে দেশের কথা বলা হচ্ছে, তা নিশ্চয়ই বোঝেন। কিন্তু এই স্লোগান থেকে আশপাশের মানুষের কী লাভ বা ক্ষতি হতে পারে, তা আর ক’জন ভেবে দেখেছেন! ভাবলে হয়তো তাঁদের অনেকেই এই স্লোগান দিতে যেতেন না। সমাজতত্ত্বের এই শিক্ষক মনে করেন, এই অভ্যাস আসলে অনেকটা গণপিটুনি দেওয়ার মতো। তিনি বলেন, ‘‘এক বার এক বন্ধু হঠাৎ ট্রাম থেকে নেমে আমার হাতে বইটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দাঁড়াও দু’ঘা দিয়ে আসি’। দেখি, রাস্তার এক পাশে কয়েক জন মিলে এক যুবককে পেটাচ্ছেন। আমার সেই বন্ধু জানতেনও না তাঁরা কেন মারছেন। আমি জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘সকলে যখন মারছেন, তখন নিশ্চয়ই পকেটমার হবে।’ তাই তিনিও মারতে চলে গেলেন।’’
তবে একদলের দাপিয়ে বেড়ানোয় এত তাড়াতাড়ি বদলাবে না কলকাতা। এমনটাই মনে করছেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে, ‘‘এমন আচরণ বেশি দিন থাকবে না। এটা একটা ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। কিছু দিন পরে থেমে যাবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy