Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

দুর্ঘটনায় ফুটো অন্ত্র, ফেরাল সরকারি হাসপাতাল

ঘটনাটি ঘটেছে চলতি বছরের মাঝামাঝি। হুগলি জেলার মৌরিগুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা, শ্রমিক গোরাচাঁদ টুডুর বড় ছেলে শিবনাথ পুকুরে স্নান করে সাইকেলে বাড়ি ফিরছিল। সামনেই একটি বড় ট্র্যাক্টর দেখে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সাইকেল নিয়ে পড়ে যায় সে।

ঘরে ফেরা: (উপরে) চিকিৎসার পরে সুস্থ শিবনাথ টুডু। নিজস্ব চিত্র

ঘরে ফেরা: (উপরে) চিকিৎসার পরে সুস্থ শিবনাথ টুডু। নিজস্ব চিত্র

জয়তী রাহা
শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০১:০৮
Share: Save:

হাসপাতালের ট্রমা কেয়ার বিভাগে যখন এসেছিল, তখন প্রায় সংজ্ঞাহীন ছিল বছর এগারোর বালক। বাইরে থেকে দেখলে আঘাতের তীব্রতা ততটা বোঝার উপায় ছিল না। দ্রুত পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করতেই দেখা গেল, অন্ত্র ফুটো হয়ে গিয়েছে বালকটির। তা-ও পেরিয়ে গিয়েছে দিন কয়েক। এই পরিস্থিতিতে বহু হাসপাতালই দায় নিতে চায়নি। কিন্তু আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা ফিরিয়ে দেননি বরং দ্রুত শুরু করেন অস্ত্রোপচার। টানা মাস দুই হাসপাতালে থাকার পরে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে শিবনাথ। যেখানে রাজ্যের সরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামো নিয়ে বিস্তর অভিযোগ ওঠে, সেখানে শিবনাথ টুডুর এই ঘটনা নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকেই।

ঘটনাটি ঘটেছে চলতি বছরের মাঝামাঝি। হুগলি জেলার মৌরিগুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা, শ্রমিক গোরাচাঁদ টুডুর বড় ছেলে শিবনাথ পুকুরে স্নান করে সাইকেলে বাড়ি ফিরছিল। সামনেই একটি বড় ট্র্যাক্টর দেখে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সাইকেল নিয়ে পড়ে যায় সে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন, তখনই শিবনাথের পেটের উপর দিয়ে চলে যায় ট্র্যাক্টরের পিছনের চাকা। দ্রুত পরিজনেদের খবর দিয়ে চুঁচুড়া জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় চার দিনের মাথায় শিবনাথকে অন্যত্র নিয়ে যেতে বলা হয়।

বিভিন্ন জায়গা থেকে ফিরিয়ে দেওয়া বালকটি ক্রমে নেতিয়ে পড়ছিল। আর জি করের ট্রমা কেয়ারে পরীক্ষার পরে ওই রাতেই অস্ত্রোপচার হয়। কারণ, শিবনাথের অন্ত্র ফুটো হয়ে ভিতরের জিনিস বেরিয়ে এসেছিল। চার দিন ওই অবস্থায় থাকার কারণে তত ক্ষণে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে শরীরে। কিডনি কাজ করা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। রক্তচাপ প্রায় ছিল না। অস্ত্রোপচারে অন্ত্রের দু’ধার কেটে, এক দিক শরীরের বাইরের একটি ব্যাগের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় কোলোস্টমি। চিকিৎসকেরা বলছেন, সংক্রমণ থাকায় ফুটো অন্ত্র সেলাই করলেও তা ফের খুলে যাবে, সে কারণেই এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসকদের পরবর্তী দায়িত্ব ছিল শিবনাথের শরীর থেকে সংক্রমণ দূর করে অঙ্গগুলির স্বাভাবিক ক্রিয়া ফিরিয়ে দেওয়া। হাসপাতালের ক্রিটিকাল কেয়ার চিকিৎসক সুগত দাশগুপ্ত বলেন, “অস্ত্রোপচারের পরপরই যখন শিবনাথকে দেখলাম, তখন ওর রক্তচাপ প্রায় ছিলই না। পাল্‌স পাওয়া যাচ্ছিল না। কিডনি কাজ করছিল না। সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন ছিল ছেলেটি। ‘সেপসিস উইথ মাল্টিঅর্গান ফেলিওর’ শুরু হয়ে গিয়েছিল। সি সি ইউ-তে ভেন্টিলেশনে রেখে দীর্ঘ দিন পর্যবেক্ষণ, ওষুধ এবং ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ওর সংক্রমণ দূর করে সুস্থ করা হয়েছে।’’ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বলছেন, ‘‘এই পদ্ধতি বিরল নয়। তবে এ ক্ষেত্রে ছেলেটির সংক্রমণ যতটা ছড়িয়েছিল, তা বিপজ্জনক। এমন পরিস্থিতিতে অত্যন্ত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং ২৪ ঘণ্টার কড়া নজরদারি প্রয়োজন। সে সবের মাধ্যমে তাকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ায় চিকিৎসকেরা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখেন।’’

চিকিৎসার দ্বিতীয় পর্যায়ে শিবনাথের দ্বিতীয় অস্ত্রোপচার সম্প্রতি হয়েছে। সংক্রমণ পুরো কেটে যাওয়ায় অন্ত্র সেলাই করা হয়েছে। বাতিল হয়েছে কোলোস্টমি ব্যাগ। শিবনাথের বাবা গোরাচাঁদ বলছেন, ‘‘ডাক্তারবাবুদের হাতে ছেলেকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। তাঁরাই ছেলেটাকে দ্বিতীয় জন্ম দিলেন।’’ যদিও হতদরিদ্র পরিবারটি কী ভাবে ফের ছেলেকে পড়াবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায়। কারণ, বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব অনেকটা। এত বড় দুর্ঘটনার পরে ফের ওই পথে ছেলেকে ছাড়তে নারাজ শিবনাথের বাবা-মা। গোরাচাঁদ বলছেন, ‘‘দেখা যাক, আবাসিক কোনও স্কুলে যদি ওর ব্যবস্থা করা যায়। তবে খরচের জন্য সেটাও পারব কি না, জানি না!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Operation R G Kar Intestine
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE