Advertisement
E-Paper

সমাধিস্থলেই ‘অরক্ষিত’ রবীন্দ্রনাথ

২২ শ্রাবণ নিয়ে যত আবেগ, যত উন্মাদনা, যত বিষাদ-প্রবণতাই থাক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘অরক্ষিত’! তাই নিমতলা ঘাটে তাঁর সমাধিস্থল অনায়াস আড্ডার জায়গা। প্রাঙ্গণের প্রবেশদ্বার ট্যাটুর বিজ্ঞাপনের প্রদর্শনীস্থল। বিশেষজ্ঞদের মতে, রবীন্দ্র-মৃত্যুতে যারপরনাই ‘কাতর’ আত্মবিস্মৃত বাঙালি নিমতলা ঘাটে সমাধিস্থল নির্মাণ করেছে বটে, সাদা মার্বল দিয়ে বাঁধিয়েছে, কিন্তু সম্মানের প্রশ্নে ন্যূনতম সৌজন্যও দেখাতে পারেনি। তাই নোবেলজয়ীর সমাধিতে এখন আড্ডার সংস্কৃতি!

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৮ ০১:৩৫
নিমতলায় রবীন্দ্রনাথের সমাধি যেন বিশ্রামের জায়গা। ছবি: সুদীপ ঘোষ

নিমতলায় রবীন্দ্রনাথের সমাধি যেন বিশ্রামের জায়গা। ছবি: সুদীপ ঘোষ

গোল করে বসে আড্ডা চলছে। চটিগুলো খুলে দূরে রাখা। ছোট-ছোট দলে ভাগ করে দু’তিন জন আড্ডা দিচ্ছেন। পিছনেই অকাতরে ঘুমোচ্ছে এক কিশোর। কেউ ডাকার নেই। আর এক জন শুয়েছিলেন ওই জায়গাতেই। কিছু ক্ষণ আগে উঠে গিয়েছেন। যেখানে এই আড্ডা-ঘুম চলছে, তার পাশেই বড় বড় হরফে লেখা, ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমাধিপ্রাঙ্গণ’!

২২ শ্রাবণ নিয়ে যত আবেগ, যত উন্মাদনা, যত বিষাদ-প্রবণতাই থাক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘অরক্ষিত’! তাই নিমতলা ঘাটে তাঁর সমাধিস্থল অনায়াস আড্ডার জায়গা। প্রাঙ্গণের প্রবেশদ্বার ট্যাটুর বিজ্ঞাপনের প্রদর্শনীস্থল। বিশেষজ্ঞদের মতে, রবীন্দ্র-মৃত্যুতে যারপরনাই ‘কাতর’ আত্মবিস্মৃত বাঙালি নিমতলা ঘাটে সমাধিস্থল নির্মাণ করেছে বটে, সাদা মার্বল দিয়ে বাঁধিয়েছে, কিন্তু সম্মানের প্রশ্নে ন্যূনতম সৌজন্যও দেখাতে পারেনি। তাই নোবেলজয়ীর সমাধিতে এখন আড্ডার সংস্কৃতি!

নিমতলায় রবীন্দ্রনাথের সমাধিস্থলের পাশে বছর তিন আগে কলকাতা পুরসভা রবীন্দ্র-স্মৃতিতে বাগান করেছে। মার্বল দিয়ে মুড়ে দিয়েছে। কিন্তু সেখানে নিরাপত্তার ন্যূনতম ব্যবস্থাটুকু রাখেনি পুরসভা! সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সেখানে নিরাপত্তারক্ষী থাকার কথা। কিন্তু তা শুধুই খাতায়-কলমে। পাশে পুরসভার দফতর থাকা সত্ত্বেও সমাধিস্থলে যে কেউ ঢুকে পড়তে পারেন। বাধাহীন, প্রশ্নহীন অবস্থায় বসে পড়তে পারেন সমাধিস্থলে, যেখানে তাঁকে দাহ করা হয়েছিল! যাঁকে নিয়ে বাঙালির আবেগের শেষ নেই, তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন বলতে শুধু মাত্র চটিজোড়া খুলে সমাধিস্থলে বিশ্রাম নিতে বসা। শুধু কী বসা! নিশ্চিন্তে ঘুমও দেওয়া যায়। কেন্দ্রীয় পুরভবন থেকে উচ্চপদস্থ কর্তারা এলে অথবা ২২ শ্রাবণের মতো বিশেষ দিন বা মুহূর্তগুলিতে কখনও-সখনও রক্ষী এসে বাইরে বের করে দেবে বটে, কিন্তু বাকি সময়ে কোনও উপদ্রব নেই। বাঙালির একান্ত আশ্রয়জনের সমাধিও তাই আজ আশ্রয়স্থল! আক্ষরিক অর্থেই।

শ্মশানের এক শবদাহক বলেন, ‘‘ওখানে তো সব সময়েই বসে থাকতে দেখি লোকজনকে। কেউ তো আটকায় না!’’ সমাধিস্থলে কেন আড্ডা বসেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন করতে কিছুটা অপ্রস্তুত নিরাপত্তাকর্মী। জানালেন, তিনি সমাধিস্থলের দায়িত্বে নেই। ওখানকার নিরাপত্তার দায়িত্বে যিনি, তিনি হয়তো কোথাও গিয়েছেন। ওই নিরাপত্তারক্ষী হন্তদন্ত হয়ে গিয়ে লোকজন সরিয়ে দিলেন। তার পরে বললেন, ‘‘কখন যে কে ঢুকে পড়ে কে জানে!’’

যাঁদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন কিছু ক্ষণ। বুঝতে পারছিলেন না প্রতিদিনের আড্ডা এ ভাবে হঠাৎ ভেঙে দেওয়ার কারণ কী! সমাধিস্থল থেকে বেরিয়ে এক জনের স্বগতোক্তি, ‘‘কী হল হঠাৎ!’’ আর এক জন বললেন, ‘‘দেখ কোনও কর্তা এসেছে হয়তো! বাবুরা এলেই তো টনক নড়ে!’’ তাঁদের মধ্যে সৎকার করতে আসা পরিবারের কেউ ছিলেন কি না, তা অবশ্য স্পষ্ট করে জানাননি কেউই।

সমাধিস্থলের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে স্বেচ্ছাসেবী এক সংস্থা। পুরসভার তরফেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ওই সংস্থার এক কর্মীর সাফাই, ‘‘লোকজনকে বারণ করলেও শোনেন না। ওখানে সেলফি তোলেন।’’

তবে ওই ঘটনা শুনে আশ্চর্য হননি অনেকেই! সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার বলেন, ‘‘এটা আর আশ্চর্যের কী! যে কোনও ব্যাপারেই আমরা বাৎসরিক হই, মানে বছরে একবার। বাকি সময়টা আমরা তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি! ২২ শ্রাবণ হলে একটু নড়াচড়া হবে, একটু জায়গা পরিষ্কার হবে। বাকি সময়টায় ওখানে সকলের আড্ডা হবে!’’ সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘যিনি নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন, তাঁরই দেখা উচিত ছিল। জায়গাটা যদি ঘিরে দেওয়া যেত, তা হলে হয়তো এমনটা হত না।’’ শিক্ষাবিদ সৌরীন ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘এটাই তো স্বাভাবিক! ২২ তারিখ আর ২৫ তারিখে ওই জায়গার মর্যাদা বোঝা যাবে। কিন্তু বাকি সময়টায় আড্ডা হবে, ঘুম হবে!’’

প্রতি বছরের মতো এ বছরেও ওখানে ২২ শ্রাবণের অনুষ্ঠান হবে। ‘ঠাকুর’-এর প্রয়াণ দিবসের অনুষ্ঠান। বাকি সময়টা না হয় ট্যাটুর বিজ্ঞাপন, আড্ডার জন্য তোলা থাক!

কলকাতার রাজনীতি, কলকাতার আড্ডা, কলকাতার ময়দান, কলকাতার ফুটপাথ - কলকাতার সব খবর জানতে পড়ুন আমাদের কলকাতা বিভাগ।

Nimtala Burial Ground Rabindranath Tagore রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy