Advertisement
E-Paper

সহকর্মীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন রঞ্জিত, ব্যর্থ সুরজিৎ

এক জন শাসকের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর পূর্বসূরি কিন্তু পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সহকর্মীদের। গত শনিবার কলকাতার ভোটগ্রহণ শেষে গিরিশ পার্কে পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টর জগন্নাথ মণ্ডল গুলিবিদ্ধ হন। রক্তপাতহীন নির্বাচনে সেটাই ছিল সে দিনের একমাত্র বড় ঘটনা। এর পাঁচ দিন পর, বৃহস্পতিবার রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ যে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন, সেখানে ধৃতদের নামধাম থাকলেও তাদের রাজনৈতিক পরিচয় জানানো হয়নি। তাঁর এই রিপোর্ট নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। সরব পুলিশের একাংশও। তাঁদের বক্তব্য, এই ভাবে আড়াল করার চেষ্টা আসলে শাসকের কাছে পুরোপুরি বশ্যতা স্বীকারেরই নামান্তর।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৫৮

এক জন শাসকের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর পূর্বসূরি কিন্তু পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সহকর্মীদের।

গত শনিবার কলকাতার ভোটগ্রহণ শেষে গিরিশ পার্কে পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টর জগন্নাথ মণ্ডল গুলিবিদ্ধ হন। রক্তপাতহীন নির্বাচনে সেটাই ছিল সে দিনের একমাত্র বড় ঘটনা। এর পাঁচ দিন পর, বৃহস্পতিবার রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ যে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন, সেখানে ধৃতদের নামধাম থাকলেও তাদের রাজনৈতিক পরিচয় জানানো হয়নি। তাঁর এই রিপোর্ট নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। সরব পুলিশের একাংশও। তাঁদের বক্তব্য, এই ভাবে আড়াল করার চেষ্টা আসলে শাসকের কাছে পুরোপুরি বশ্যতা স্বীকারেরই নামান্তর।

জগন্নাথ মণ্ডল প্রাণে বেঁচে গেলেও বছর দুয়েক আগে গার্ডেনরিচে হরিমোহন ঘোষ কলেজের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গোলমালের সময় দুষ্কৃতীর গুলিতে প্রাণ হারান তাপস চৌধুরী নামে এক সাব-ইনস্পেক্টর। সেই ঘটনায় নাম জড়ায় পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের ঘনিষ্ঠ তৃণমূল কাউন্সিলর তথা বরো চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নার। ঘটনায় পুলিশকর্মীদের ক্ষোভ চরমে ওঠে। এফআইআরে মুন্নার নাম রাখা হবে কি না, সে প্রশ্নও ওঠে। তার মধ্যেই ফিরহাদ হাকিম দাবি করেন, মুন্না ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। কিন্তু মন্ত্রীর সেই বক্তব্যকে উপেক্ষা করেই তৎকালীন পুলিশ কমিশনার রঞ্জিৎ কুমার পচনন্দার নির্দেশে মুন্নার নাম এফআইআর-এ রাখা হয়। তাঁর নির্দেশেই সক্রিয় হয়ে পুলিশ পরে বিহার থেকে গ্রেফতারও করে মুন্নাকে। এর পরে পচনন্দাকে আর পুলিশ কমিশনারের পদে রাখেননি নবান্নের কর্তারা।

গার্ডেনরিচ থেকে গিরিশ পার্ক— গত চার বছরে শাসক দলের কাছে একাধিক বার পুলিশকে অপদস্থ হতে হয়েছে। এমনকী খাস কলকাতার বুকে থানায় ঢুকে নেতার দলবল পিটিয়ে গেলেও পুলিশ টেবিলের নীচে ঢুকে আত্মরক্ষা করা ছাড়া বিশেষ কিছুই করে উঠতে পারেনি! গিরিশ পার্কের ঘটনা নিয়ে সিপি-র রিপোর্টের পর এ বার নিচুতলার কর্ম়ীদের মনোবল আরও তলানিতে ঠেকল বলেই মনে করছেন অনেকে।

গিরিশ পার্ক-কাণ্ডে সিপি-র রিপোর্ট নিয়ে যতই সমালোচনা হোক, রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু কমিশনারের পাশেই দাঁড়িয়েছেন। শুক্রবার নবান্নে তিনি বলেন, ‘‘গিরিশ পার্কের ঘটনা ভোট শেষ হওয়ার পরে ঘটেছে। ভোটের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। তবুও যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের পুলিশ গ্রেফতার করেছে।’’ মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘‘কলকাতা পুলিশ এবং আমার প্রশাসন খুব ভাল কাজ করেছে। এটার জন্য কারও কাছে জ্ঞান নেওয়ার প্রয়োজন নেই।’’

গিরিশ পার্ক-কাণ্ডের রাতেই দু’জনকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। পরে আরও চার জন ধরা পড়েছে। ধৃতদের প্রায় প্রত্যেকের পরিবারের তরফেই দাবি করা হয়েছে, তারা শাসক দলের সক্রিয় কর্মী। একই কথা শোনা গিয়েছে পুলিশের বিভিন্ন মহল থেকেও। ধৃতদের মধ্যে চার জন তৃণমূল নেতা সঞ্জয় বক্সীর ঘনিষ্ঠ গোপাল তিওয়ারির শাগরেদ বলে পরিচিত। তৃণমূলের মন্ত্রী ও নেতাদের সঙ্গে গোপাল তিওয়ারি-সহ ধৃতদের একাধিক ছবিও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। ভোটের দিন গিরিশ পার্ক এলাকা দাপিয়ে বেড়িয়েছে তারা। তবু নির্বাচন কমিশনারের কাছে ধৃতদের রাজনৈতিক পরিচয় জানাননি সিপি!

কেন? লালবাজার ও জেলা পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছেন, এমন একাধিক পুলিশকর্তা বলছেন, অধিকাংশ অফিসারই নির্বাচনী সংঘর্ষ কিংবা অন্য রাজনৈতিক সংঘর্ষে শাসক দলকে অল্পবিস্তর ছাড় দিয়ে নিজের চাকরি বাঁচান। প্রশাসন চালানোর ক্ষেত্রে এটাই ‘অলিখিত নির্দেশ’! কিন্তু এটা তত ক্ষণই করা যায়, যত ক্ষণ তা বাহিনীর মনোবলে ধাক্কা না মারে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুর থানার উদাহরণ টেনে ওই জেলার এক প্রাক্তন এসপি বলেন, ‘‘বছর ছয়েক আগে এক ধৃতের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ দেখানোর সময় পুলিশের উর্দি ধরে টানাটানি করেছিল শাসক দলের কর্মীরা। পুলিশ তাদের বেধড়ক মেরেছিল। গ্রেফতারও করেছিল কয়েক জনকে। পুলিশের গায়ে হাত দেওয়া সে দিন বরদাস্ত করেননি থানার ওসি। সমর্থন ছিল আমারও।’’

কিন্তু গিরিশ পার্কে বাহিনীর এক কর্মীকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেও কেন দুষ্কৃতীদের রাজনৈতিক পরিচয় আড়াল করে রিপোর্ট দিলেন সিপি, এখন সেই প্রশ্নই পাক খাচ্ছে প্রশাসনের অন্দরে। গুলি-কাণ্ডে ধৃত দুই দুষ্কৃতীর সঙ্গে মধ্য কলকাতার একাধিক তৃণমূল নেতার ঘনিষ্ঠতা ছিল। কলকাতা পুলিশের নিজস্ব গোয়েন্দা শাখাও ধৃতদের রাজনৈতিক যোগাযোগ নিয়ে বড়কর্তাদের বিস্তারিত রিপোর্ট দিয়েছে। তারপরেও সিপি-র এমন আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পুলিশেরই একাংশ।

তাঁদের মতে, আইনশৃঙ্খলা থেকে ভোটের কাজ— শাসক দলের সঙ্গে টক্কর দিয়ে কোনও সিপি-ই পদে থাকতে পারেন না। বেশির ভাগ সেই চেষ্টাও করেন না। কিন্তু বাহিনীর কেউ আক্রান্ত হলে অফিসারেরা কাউকে রেয়াত করবেন না— এটাই দস্তুর। যেমন করেননি পচনন্দা। তারও আগে রিজওয়ানুর-কাণ্ডে বিতর্কিত মন্তব্য করে বাম সরকারের রোষে পড়লেও অভিযুক্ত অফিসারদের হাড়িকাঠে দাঁড় করাননি তৎকালীন সিপি প্রসূন মুখোপাধ্যায়। সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ সে পথে হাঁটতে পারলেন না!

লালবাজারের অন্য একটি অংশ অবশ্য মনে করেন, বর্তমান সিপি আইন মেনে কাজ করেছেন। তাঁদের ব্যাখ্যা, ধৃতেরা কোন রাজনৈতিক দলের ঘনিষ্ঠ, সেটা নির্বাচন কমিশনকে জানানোর বাধ্যবাধকতা নেই। তা ছাড়া গিরিশ পার্ক কাণ্ডে ধৃতেরা তৃণমূলের কোনও জনপ্রতিনি‌ধি নন। এমনকী, দলের পদাধিকারীও নন। তাই তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয় পুলিশি রিপোর্টে উল্লেখ করার প্রশ্ন নেই। লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘কাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তা নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছি। কমিশন যদি ধৃতদের রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চায়, আমরা জানিয়ে দেব।’’ এই নিয়ে সুরজিৎবাবু অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

পুলিশ সূত্রের খবর, গিরিশ পার্ক-কাণ্ডে রিপোর্ট তৈরি করেছেন গিরিশ পার্ক থানার ওসি। তাতে ডিসি (সেন্ট্রাল) আরও কিছু তথ্য ও মন্তব্য সংযোজন করেছেন। সিপি সেই রিপোর্ট অনুমোদন করেছেন বটে, তবে তাতে তাঁর সই নেই। নির্বাচন কমিশনে পাঠানো ওই রিপোর্টে সই করেছেন যুগ্ম-কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র। যদিও পুলিশের একাংশের মতে, নির্বাচন কমিশন রিপোর্ট চেয়েছিল সিপি-র কাছে। সুতরাং কে রিপোর্ট তৈরি করেছেন, তা কমিশনের দেখার কথা নয়। কমিশন যে রিপোর্ট হাতে পেয়েছে, তা পুলিশ কমিশনারের রিপোর্ট বলেই গণ্য হবে।

পুলিশের উর্দি ও বাহিনীর সম্মানের চেয়ে শাসক দলের বশ্যতা স্বীকারই বড় কি না, গিরিশ পার্ক নিয়ে সিপি-র রিপোর্টের পর সেই প্রশ্নই ফের মাথা চাড়া দিচ্ছে।

Surajit kar purakayastha ranjit pachnanda kolkata police colleagues sub inspestor shot jagannath mondal kolkata police kmc vote violence
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy