Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

গবেষণা গোল্লায়, সুর পাল্টে মানছে এখন প্রেসিডেন্সিই

ঝুলি ফুঁড়ে বেড়াল শেষমেশ বেরিয়েই পড়ল! এত দিনকার অবস্থানে একশো আশি ডিগ্রি মোচড় দিয়ে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় স্বীকার করে নিল, গবেষণার ঠিকঠাক পরিকাঠামো তাদের নেই! অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, গবেষক পর্যন্ত নেওয়া যাচ্ছে না! নতুন গবেষণা কার্যত শিকেয়।

মধুরিমা দত্ত
শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৬ ০৩:৩৭
Share: Save:

ঝুলি ফুঁড়ে বেড়াল শেষমেশ বেরিয়েই পড়ল! এত দিনকার অবস্থানে একশো আশি ডিগ্রি মোচড় দিয়ে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় স্বীকার করে নিল, গবেষণার ঠিকঠাক পরিকাঠামো তাদের নেই! অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, গবেষক পর্যন্ত নেওয়া যাচ্ছে না! নতুন গবেষণা কার্যত শিকেয়।

এবং দুর্দশার নেপথ্যে প্রেসিডেন্সি নিয়ে সঠিক প্রস্তুতি-পরিকল্পনায় ঘাটতির ভূমিকা বড় হয়ে উঠছে। আসছে স্থানাভাবের প্রসঙ্গ। যার সূত্র ধরে কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের ক্ষেত্রে ‘অনর্থক তাড়াহুড়ো’র পুরনো অভিযোগ মাথা চাড়া দিয়েছে শিক্ষাবিদ মহলে।

প্রেসিডেন্সিকে উৎকর্ষ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বেশ কিছু প্রথিতযশা শিক্ষককে আনা হয়েছিল। শিক্ষা-যজ্ঞে সামিল হতে ওঁরা যেমন অঢেল উৎসাহ নিয়ে এসেছিলেন, তেমন ওঁদের দেখে পড়ুয়ারাও আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ হতে দেরি হয়নি। গত তিন বছরে একের পর এক শিক্ষক প্রেসিডেন্সি ছেড়ে চলে গিয়েছেন। কেউ কেউ আসার জন্য পা বাড়িয়েও শেষ পর্যন্ত আসেননি। কেউ আবার সাময়িক ভাবে অন্যত্র গিয়ে আর এ মুখো হননি। অধিকাংশের একটাই অভিযোগ— প্রেসিডেন্সিতে বসে উচ্চ মানের গবেষণা অসম্ভব। কারণ, এখানে তার উপযুক্ত বন্দোবস্ত নেই।

প্রেসিডেন্সি-কর্তৃপক্ষ অবশ্য এ যাবৎ অভিযোগটি ফুৎকারে উড়িয়েছেন। উল্টে তাঁদের দাবি ছিল, বেশি বেতনের টানেই শিক্ষকেরা অন্য প্রতিষ্ঠানে গিয়েছেন। তবে এখন শোনা গেল সম্পূর্ণ উল্টো সুর! পড়ুয়ারা গবেষণার জন্য নাম নথিভুক্ত করাতে চাওয়ামাত্র কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাযথ গবেষণা-পরিকাঠামো না-থাকায় এই মুহূর্তে কাউকে নেওয়া সম্ভব নয়!

বস্তুত গবেষক বাছাইয়ের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ফি বছর নিজস্ব যে পরীক্ষা (রিসার্চ এলিজিবিলিটি টেস্ট, সংক্ষেপে রেট) নেয়, ২০১৪-র পরে প্রেসিডেন্সিতে তা হয়নি। প্রতি বিভাগে বছরে অন্তত দু’বার গবেষণার স্কলার নেওয়ার কথা থাকলেও আপাতত তা বন্ধ রয়েছে।

ফলে প়ড়ুয়াদের ভোগান্তির একশেষ। যেমন, বিদেশি স্কলারশিপ পেয়েও প্রেসিডেন্সিতে রিসার্চের অপেক্ষায় দেড় বছর বসে থেকে জীবনবিজ্ঞানের এক ছাত্রী শেষে মুম্বইয়ে পাড়ি দিয়েছেন। আর এক ছাত্রী নামী স্কলারশিপের জন্য মনোনীত হয়েও প্রেসিডেন্সিতে গবেষণার সুযোগ পাচ্ছেন না। বাংলা বিভাগের এক পড়ুয়ার খেদ, ‘‘প্রত্যেক প্রফেসর আট জন পর্যন্ত রিসার্চ স্কলার নিতে পারেন। প্রেসিডেন্সিতে শেষ বারের অনুপাত ছিল শিক্ষকপিছু মাত্র দু’জন। এখন তা-ও নেই!’’

পরিস্থিতি সত্যিই এত খারাপ?

প্রেসিডেন্সির উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া মন্তব্য করতে চাননি। তিনি জানিয়ে দেন, যা বলার রেজিস্ট্রার বলবেন। রেজিস্ট্রার দেবজ্যোতি কোনার অবশ্য রাখ-ঢাক করেননি। তাঁর সাফ কথা, ‘‘ভাল গবেষণার জন্য যে পরিকাঠামো দরকার, তা এই মুহূর্তে এখানে নেই।’’ দ্রুত সুরাহার ইঙ্গিতও অধরা। রেজিস্ট্রারের কথায়, ‘‘২০১৭-র শেষে রাজারহাটে আমাদের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস তৈরি শেষ হবে। তার পরে গবেষকদের ঠিকঠাক পরিকাঠামো দেওয়া যাবে।’’

তত দিন গবেষক নিয়োগ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা কার্যত অসম্ভব বলে জানিয়েছেন রেজিস্ট্রার। এখন অবস্থাটা ঠিক কী রকম?

সূত্রের খবর: অনেক ল্যাবরেটরি প্রায় কুড়ি বছর পিছিয়ে! দরকারি যন্ত্রপাতি নেই। বিজ্ঞানের শিক্ষকদের জন্য আলাদা ল্যাব করার জায়গা নেই। যেগুলো ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের পর্বে অধিকাংশের প্রায় পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে। ল্যাবের মধ্যেই হামেশা ক্লাস চলে, কারণ ক্লাসরুমের অভাব। প্রশিক্ষিত ল্যাব-কর্মীরও বালাই নেই।

‘নেই রাজ্যের’ বাসিন্দা হয়ে শিক্ষকদেরও আক্ষেপের শেষ নেই। ‘‘বহু ছেলে-মেয়ে নেট পাশ করে বসে আছে। অথচ এখানে গবেষণার জায়গা নেই।’’— বলছেন বিজ্ঞানের এক শিক্ষক। তাঁর প্রশ্ন— ‘‘কত ভাল গবেষণা হল, নামী জার্নালে কত পেপার বেরলো, তা দিয়েই তো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বোঝা যায়! প্রেসিডেন্সিতে সেই সুযোগ বন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কী লাভ?’’

এমতাবস্থায় ইউজিসি বা ন্যাক কী ভাবে প্রেসিডেন্সির মূল্যায়ন করবে, তা-ও ওঁদের মাথায় ঢুকছে না। ঘটনা হল, কলেজ থাকাকালীনও প্রেসিডেন্সি থেকে পিএইচডি, ডিএসসি বেরিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পরে গবেষণার সংখ্যা ও মান বাড়ার কথা। তার বদলে উলটপুরাণ কেন?

প্রাক্তনীদের একাংশ দুষছেন দূরদর্শিতার অভাব ও গা এলানো মনোভাবকে। ওঁদের অনেকের অভিযোগ, ‘‘সাবেক প্রেসিডেন্সি কলেজেও অধিকাংশ বিভাগ গবেষণার পরিকাঠামোকে খুব একটা কাঙ্খিত মানে তুলতে আনতে পারেনি। সেই অবস্থায় আচমকা তাকে বিশ্ববিদ্যালয় করে দেওয়া হল। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের গবেষণা চালানোর মতো প্রশস্ত জায়গা সেখানে আছে কিনা, ভাবা হল না! এই হঠকারিতার খেসারত দিচ্ছে ছেলে-মেয়েরা।’’ প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী সংসদের সম্পাদক বিভাস চৌধুরী বলেন, ‘‘একটা বিশ্বমানের কলেজ বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় হবে না নিম্নমানের, তা নির্ভর করে অনেক কিছুর উপরে। যেমন, কী ধরনের গবেষণা হচ্ছে। বলতে খারাপ লাগে, সেই নিরিখে প্রেসিডেন্সি এখনও বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে পারেনি। সত্যিই আমাদের পরিকাঠামো নেই।’’

দেখে-শুনে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য মালবিকা সরকার অবাক। ‘‘২০১০-এ আত্মপ্রকাশ করা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা থমকে থাকা দুর্ভাগ্যজনক।’’— পর্যবেক্ষণ তাঁর। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায়ের হতাশ মন্তব্য, ‘‘সেকেন্ড ক্যাম্পাস না-হলে স্কলার নিয়োগ হবে না, এমনটা অভাবিত। যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষের কাজ গবেষণায় ক্রমাগত উত্সাহ দিয়ে যাওয়া। পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন।’’

অথচ এখানে একেবারে উল্টো দৃশ্য! দু’শো বছরের চৌকাঠে দাঁড়ানো প্রতিষ্ঠানটির ঐতিহ্যের সঙ্গে এ যে চূড়ান্ত বেমানান, সে ব্যাপারে সব মহল মোটামুটি একমত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Presidency college
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE