তিনি বরাবর চলেন নিজের মতে, নিজের পথে। শুক্রবার সন্ধ্যায় ‘ছাঁদনাতলা’য় যখন গেলেন পাত্র দিলীপ ঘোষ, তখনও তার ব্যতিক্রম হল না। তিনি রইলেন নিজের নিউ টাউনের বাড়িতেই। সেখানেই শুক্রবার সন্ধ্যায় বধূবেশে এলেন পাত্রী রিঙ্কু মজুমদার। ঘরেই বসল বিয়ের আসর। গোধূলি লগ্নে এক হল চার হাত। দিলীপের ইচ্ছামতো গাঁটছড়া বাঁধার সাক্ষী থাকলেন শুধুই বর-কনের পরিবার এবং তাদের ঘনিষ্ঠ কয়েক জন। বিয়ে পর্ব মিটে যাওয়ার পরে বাড়ির বাইরে এসে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি জানিয়ে দিলেন, মায়ের (দিলীপের) দায়িত্ব যাতে আরও ভাল ভাবে পালন করতে পারেন, তাই এই সিদ্ধান্ত। তবে বিয়ে করলেও তিনি রাজনৈতিক দায়িত্ব থেকে সরছেন না। আর সেই কাজে দিলীপের পাশে থাকার বার্তা দিলেন নববধূ রিঙ্কু।
দিলীপের বয়স এখন ৬১। তাঁর বিয়ের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পরেই রাজনৈতিক পরিসর থেকে সমাজমাধ্যম— সর্বত্রই শোরগোল পড়ে যায়। বিয়ের পক্ষে-বিপক্ষে বহু মন্তব্য জমতে থাকে সমাজমাধ্যমের পাতায়। যদিও দিলীপ স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছিলেন, মায়ের ইচ্ছাতে বিয়ে করছেন তিনি। বিয়ে সেরে শুক্রবার সন্ধ্যাতেও দিলীপ বলেন, ‘‘আমি যাতে জীবনের দায়িত্ব আরও ভাল ভাবে পালন করতে পারি, মায়ের দায়িত্ব পালন করতে পারি, তাই এই সিদ্ধান্ত।’’ পাশাপাশি জানান, রাজনীতিতে তিনি আগের মতোই সক্রিয় থাকবেন। তাঁর স্ত্রী রিঙ্কুও বিজেপি কর্মী। সে কথা মনে করিয়ে স্বামী দিলীপ কথায়, ‘‘রিঙ্কুও দলের কর্মী। দল যে দায়িত্ব দেবে, শক্তি, সামর্থ দিয়ে সেই কাজ করব আমরা।’’ নববধূও দাঁড়িয়েছেন স্বামীর পাশে। রিঙ্কুর কথায়, ‘‘পার্টি ওকে যে ভাবে দেখতে চায়, সে ভাবেই পাবে। এটাই আমি নিশ্চিত করতে চাই।’’

দিলীপ ঘোষের বাড়ির বাইরে কড়া প্রহরা। ছবি: পিনাকপাণি ঘোষ।
দিলীপের ঘনিষ্ঠ সূত্রে খবর, ‘ঘটা’ করে বিয়ের পক্ষপাতী ছিলেন না বিজেপির প্রাক্তন সাংসদ ও প্রাক্তন বিধায়ক। সাদামাটা ভাবেই তাঁর নিউটাউনের ফ্ল্যাটে বিয়ের আয়োজন করা হয়। রীতি-আচার মেনে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি-টোপর পরে ‘ছাঁদনাতলা’য় যান দিলীপ।
কনের সাজও ছিল সাবেক। পরনে লাল বেনারসি। মাথায় শোলার মুকুট, কপালে ছোট টিপ, মাথায় লাল ওড়না। নিউ টাউনের এক শপিং মলের পার্লারে শুক্রবার দুপুরে সাজতে গিয়েছিলেন রিঙ্কু। সেখান থেকেই বিকেলে সোজা দিলীপের নিউ টাউনের ফ্ল্যাটে পৌঁছোন। সঙ্গে ছিলেন জনা পনেরো কনেযাত্রী। রিঙ্কু বিবাহবিচ্ছিন্না। সেই পক্ষের এক পুত্রসন্তান রয়েছেন তাঁর। রিঙ্কু-পুত্র বছর পঁচিশের সৃঞ্জয় আনন্দবাজার ডট কমকে জানিয়েছেন, ইচ্ছা থাকলেও তিনি বিয়েতে থাকতে পারছেন না। সল্টলেকের একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কাজ করেন সৃঞ্জয়। গুড ফ্রাইডের ছুটি কাটাতে তিনি কলকাতার বাইরে রয়েছেন। সেখান থেকেই জানিয়েছেন, তাঁর মায়ের এই সিদ্ধান্তে তিনি ভীষণ খুশি। দু’জনের জন্য উপহারও আনবেন বলে জানিয়েছেন সৃঞ্জয়।

বিয়ের পিঁড়িতে দিলীপ ঘোষ। ছবি: পিনাকপাণি ঘোষ।
বিয়েবাড়ির ভিতরে লোক ছিল হাতেগোনা। সবই দিলীপের ইচ্ছায়। বিয়ের আসরে কোনও হাইপ্রোফাইল নেতাকে দেখা যায়নি। এমনকি, বিয়ের ভোজের তালিকাও আড়ম্বরহীন। খাবারের তালিকায় বাঙালিয়ানার ছোঁয়া— লুচি, তরকারি, পোলাও। ছিল একটি মাত্র মাছের পদ। মাংস ছিল না। শেষপাতে ছিল মিষ্টি।

দিলীপ ঘোষের বিয়ের ভোজ। — নিজস্ব চিত্র।
বিয়ের আচার পালন করলেও প্রাক্তন সাংসদ দিলীপ বার বার জানিয়েছেন, তাঁর দৈনন্দিন কর্মসূচিতে কোনও পরিবর্তন হবে না। সূত্রের খবর, প্রতি দিনের মতো বিয়ের পরের দিন, শনিবার সকালেও নিউ টাউনে প্রাতর্ভ্রমণে বেরোবেন তিনি। সঙ্গে নববধূ অবশ্য থাকবেন না। রীতি-আচার মেনে বিয়ের পরের দিন বাড়িতেই থাকবেন রিঙ্কু। ঘটনাচক্রে, শনিবার দিলীপের জন্মদিন। প্রাতর্ভ্রমণের সঙ্গীরা সকালে তাঁর জন্মদিন পালন করতে পারেন।

দিলীপের বাড়িতে বধূবেশে রিঙ্কু মজুমদার। ছবি: পিনাকপাণি ঘোষ।
দমদমে শনিবার দিলীপের একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি রয়েছে। তিনি সেখানে যোগ দেবেন বলে জানিয়েছেন। তবে তার পরে মধুচন্দ্রিমারও পরিকল্পনা রয়েছে বলে বিয়ে পর্ব মিটতেই জানান দিলীপ। তাঁর কথায়, ‘‘গত ৪০ বছর ধরেই আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি।’’ কোথায় যাবেন নবদম্পতি? দেশের মধ্যে না কি বিদেশে? দিলীপের জবাব, ‘‘দেশে এত ভাল জায়গা থাকতে বিদেশে কেন যাব?’’ রিঙ্কু অবশ্য আগেই এ নিয়ে ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর পাহাড় পছন্দ। নিরিবিলি কোনও পাহাড়ি এলাকায় দিলীপের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। প্রাথমিক ভাবে হিমাচলপ্রদেশের শিমলার কথাও ভাবা হয়েছে। তবে এখনও কোনও নাম চূড়ান্ত হয়নি।
শুক্রবার সকালে দিলীপের বাড়িতে শুভেচ্ছাবার্তা-সহ ফুলের তোড়া পাঠান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়। তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে এসেছিলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার, প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়-সহ দলের একাধিক নেতা। অনেকেই দিলীপকে উপহার দিয়েছেন। সুকান্ত নিয়ে গিয়েছিলেন ফুলের তোড়া, মিষ্টির বাক্স আর দিলীপের জন্য ধুতি-পাঞ্জাবি। দিলীপ আবার পাল্টা সকলকে প্রতি-উপহার দিয়েছেন। লকেটকে দিয়েছেন শাড়ি। বাকিদের কাউকে দিয়েছেন পাজামা-পাঞ্জাবির সেট, কাউকে পাঞ্জাবি বানানোর কাপড়। কাউকে দিয়েছেন ধুতি। অতিথিদের আপ্যায়ন করেন দিলীপের মা পুষ্পলতা ঘোষ। তবে দিলীপের বাড়িতে যেতে বা তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে দেখা যায়নি রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে। পরে তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘দলের তরফে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠানো হয়েছে। আমি তো দলেরই এক জন।’’ শুক্রবার বিকেলে যদিও বিয়েতে কোনও নেতা-মন্ত্রীকে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়নি। এই প্রসঙ্গে সুকান্ত বলেন, ‘‘বিয়েতে আমাদের থাকা সম্ভব হবে না। আমি নিজে বালুরঘাট চলে যাচ্ছি। খুব ঘনিষ্ঠ যাঁরা, তাঁদের দু’একজন বিয়েতে থাকবেন।’’
সেই ঘনিষ্ঠবৃত্তেই সাদামাটা ভাবে বিয়ে সারলেন দিলীপ।