সপ্তাহখানেক ধরে ধারাবাহিক ডাকাতির পর্ব চলছে শহরে। সেই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন গল্ফগ্রিন।
দিন সাতেকের মধ্যেই পরপর কখনও রিজেন্ট পার্কে ‘ভদ্র-সভ্য’ ডাকাতেরা বুঝিয়ে-সুঝিয়ে লুঠ করে পালিয়েছে, কখনও হরিদেবপুরে পরিচারিকার মাথায় আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে ঘরে ঢুকে লুঠপাট করেছে। কেউ ধরা পড়ার আগেই ঘটে চলেছে একের পর এক ঘটনা।
পুলিশ সূত্রে খবর, বুধবার গভীর রাতে ৭-৮ জনের একটি সশস্ত্র দল মুখে গামছা বেঁধে যাদবপুরের উদয়শঙ্কর সরণির একটি বাড়িতে চড়াও হয়। পাঁচিল টপকে গ্রিল কেটে ওই দোতলা বাড়ির নীচের ঘরের দরজা ভেঙে ঢোকে। নীচের ঘরে ঘুমোচ্ছিলেন পেশায় আইনজীবী হীরক মুখোপাধ্যায়, তাঁর পাঁচ বছরের কন্যা ও স্ত্রী। দুষ্কৃতীরা হীরকবাবুর মেয়ের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে লুঠ চালায়। সব ঘর খুলিয়ে নগদ এক লক্ষ টাকা, কয়েক ভরি গয়না নিয়ে চম্পট দেয়। শুক্রবার দুপুরে যাদবপুর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন হীরকবাবু। যাদবপুর থানার এক পুলিশ আধিকারিকের কথায়, ‘‘ডাকাতের দল লুঠ করে চলে যাওয়ার সময়ে শাসিয়ে যায়, পুলিশকে জানালেই মেরে ফেলা হবে। তাই আতঙ্কে তাঁরা অভিযোগ করতে দেরি করেছেন।’’
শুক্রবার বিকেলে বাইপাস এলাকার পঞ্চান্নগ্রামে এক পানশালার গায়িকার বাড়ি থেকে চার জন আটক হয়েছেন। রাতে লালবাজারের এক কর্তা বলেন, ‘‘আমরা নিশ্চিত, এই চার জনই শহরের পরপর ডাকাতির ঘটনায় যুক্ত। কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।’’
তবুও কলকাতা পুলিশের সংযোজিত এলাকার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। গত পাঁচ মাসে বাঁশদ্রোণী, সার্ভে পার্ক, রিজেন্ট পার্ক, গড়িয়া, পর্ণশ্রী থানায় একের পর এক চুরি, লুঠপাট চলছে। যদিও লালবাজারের কর্তাদের দাবি, কলকাতা পুলিশের আওতায় আসার পরে এই সব এলাকায় অপরাধ কমেছে। কিন্তু বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক যে বেড়েছে ফের তার প্রমাণ গল্ফগ্রিন। বুধবার রাতে সেখানে যে বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে, তার উল্টো দিকেই থাকেন শবরী দাস। তাঁর কথায়, ‘‘এখানে আগে কখনও ডাকাতি হয়নি। এই ঘটনায় আমরা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। রাতে টহলরত পুলিশ সতর্ক থাকলে এমন হত না।’’ যদিও গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, ‘‘ওই এলাকায় রাতে টহলদারি পুলিশ থাকে।’’
কিন্তু এ ধরনের একের পর এক ঘটনার পরেও পুলিশ দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারছে না কেন?
পুলিশ সূত্রেই খবর, শহরতলির বিভিন্ন এলাকাকে কলকাতা পুলিশের আওতায় আনা হলেও, পরিকাঠামো উন্নত নয়। তা ছাড়া, কয়েকটি থানা এলাকা এতটাই বড় যে সেখানে একই সংখ্যক পুলিশ দিয়ে নিরাপত্তা দেওয়াটা অসম্ভব। বিশেষ করে বেহালা ডিভিশনের হরিদেবপুর থানা। পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, শহরতলির বেশিরভাগ থানারই সীমানা দশ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে। কিন্তু হরিদেবপুর থানার সীমানা বাইশ বর্গ কিলোমিটার। অথচ পুলিশকর্মীর সংখ্যা এক। হরিদেবপুর থানা এলাকাকে ভেঙে বড়িশা এবং যাদবপুরকে ভেঙে গল্ফগ্রিন থানা করার প্রস্তাব থাকলেও ফোর্সের অভাবে গত দু’বছর ধরে তা সম্ভব হচ্ছে না। শুধু তা-ই নয়, বদলেছে অপরাধের ধরনও। ফ্ল্যাটবাড়ি বাড়ার পর থেকে প্রোমোটারও বেড়েছে। যুক্ত হয়েছে সিন্ডিকেট ব্যবসার গোলমালও। স্থানীয়েরাই জানাচ্ছেন, আগে পুজোর আগে ছোটখাটো চুরি হত। ইদানীং ছিনতাই এবং আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে লুঠপাঠ চলছে দেদার।
২০১১-র সেপ্টেম্বরের পর থেকে হরিদেবপুর, কবরডাঙা, ঠাকুরপুকুর, জোকা-সহ বাইশ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে হরিদেবপুর থানার আওতায় এনে কলকাতা পুলিশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু চার বছর পেরোলেও কলকাতা পুলিশের কোনও পরিকাঠামোই এখানে নেই বলে অভিযোগ। একটি বিস্তীর্ণ অংশে এখনও সিসি ক্যামেরা বসেনি। বিশেষ করে কবরডাঙা বা ঠাকুরপুকুর মোড় হয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার গ্রামীণ এলাকায় গা ঢাকা দেওয়াটা খুবই সহজ। স্থানীয়দের অভিযোগ, রাতে ভিতরের রাস্তাগুলিতে পুলিশি টহলদারি থাকে না। যদিও পুলিশ সূত্রে খবর, হরিদেবপুর থানায় এই মুহূর্তে তিনটে মোটরবাইক, যেগুলি নিয়ে রাতে অলিগলিতে টহল চলে।
পুলিশের একাংশের দাবি, পরিকাঠামো ও পুলিশকর্মী না বাড়ালে এত বড় জায়গার নিরাপত্তা বাড়ানো সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে হরিদেবপুর থানায় এসআই, এএসআই, কনস্টেবল, হোমগার্ড মিলিয়ে পুলিশকর্মীর সংখ্যা বড়জোর ৯০-১০০। বড় গাড়ি ও সুমো একটি করে, মোটরবাইক তিনটি। দু’টি সাইকেল অধিকাংশ সময়েই খারাপ হয়ে পড়ে থাকে। এই পরিকাঠামোয় ২২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা কী ভাবে সামলানো যাবে, তা নিয়ে সন্দিহান খোদ পুলিশই।
তথ্য: শিবাজী দে সরকার, দীক্ষা ভুঁইয়া ও মেহবুব কাদের চৌধুরী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy