Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বন্ধ ঘরে পাওয়া গেল মহিলার দেহ

সকালে পাড়ার একটি বাড়ি থেকে কটু গন্ধটা ছড়াচ্ছিল। দুপুর হতেই তা কার্যত সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত একদল বাসিন্দা ওই বাড়ির একতলার একটি ঘরের জানলা খুলে উঁকি দিতেই আঁতকে ওঠেন। মেঝের উপরে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছেন ওই ঘরের আবাসিক। হাত-পা গামছা দিয়ে বাঁধা! দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ওই মহিলার দেহে প্রাণ নেই।

প্রতিমার মৃতদেহ। — নিজস্ব চিত্র।

প্রতিমার মৃতদেহ। — নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৫ ০২:১৮
Share: Save:

সকালে পাড়ার একটি বাড়ি থেকে কটু গন্ধটা ছড়াচ্ছিল। দুপুর হতেই তা কার্যত সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত একদল বাসিন্দা ওই বাড়ির একতলার একটি ঘরের জানলা খুলে উঁকি দিতেই আঁতকে ওঠেন। মেঝের উপরে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছেন ওই ঘরের আবাসিক। হাত-পা গামছা দিয়ে বাঁধা! দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ওই মহিলার দেহে প্রাণ নেই। ওই দলের মধ্যে ছিলেন মহিলার এক দেওরও। দাদার কাছ থেকে ফোন পেয়েই বৌদির খোঁজ নিতে এসেছিলেন তিনি।

ঘটনাস্থল, গিরিশ পার্ক থানার সিংহিবাগান এলাকার বারাণসী ঘোষ স্ট্রিট। যে রাস্তার মোড়েই পুরভোটের বিকেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন সাব-ইনস্পেক্টর জগন্নাথ মণ্ডল।

সোমবার দুপুরে খবর পেয়ে দরজা ভেঙে ওই ঘরে ঢোকে পুলিশ। প্রাথমিক তদন্তে লালবাজার জানিয়েছে, প্রতিমা মাইতি (৪৫) নামে ওই মহিলাকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে। খুন করার আগে তাঁর উপরে যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছে কি না, সে বিষয়ে পুলিশ নিশ্চিত নয়। শনিবার ওই মহিলাকে শেষ বার দেখেছিলেন পাড়ার লোকেরা। ওই রাতেই প্রতিমার ঘর থেকে এক ব্যক্তিকে বেরোতে দেখেন বলে দাবি করেছেন পাড়ার এক বাসিন্দা।

এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, পুরনো দিনের দোতলা বাড়ি। তার একতলায় প্রতিমার শোয়ার ঘরে দরজার তালা ভাঙা। ভিতরে-বাইরে পুলিশে ছয়লাপ। দেহটি ময়না-তদন্তে পাঠানোর তোড়জো়ড় করছে পুলিশ। তদন্তকারীরা জানান, প্রতিমার সারা মুখে রক্ত জমাট বেঁধে ছিল। ঠোঁটের কোনায় ছিল রক্তের দাগ। সারা শরীরে পচন ধরে গিয়েছিল। হাত-পা টানটান করে বাঁধা ছিল। শরীরের ঊর্ধ্বাংশে একটি চাদর চাপা দেওয়া ছিল। কিন্তু নিম্নাংশে কোনও পোশাক বা আবরণ ছিল না।

প্রাথমিক ভাবে পুলিশের সন্দেহ, শনিবার রাতে সম্ভবত প্রতিমাকে খুন করা হয়েছে। সে কারণেই দেহে পচন ধরে গিয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। তাই দেহে কোনও আঘাতের চিহ্ন রয়েছে কি না, তা-ও পুরোপুরি স্পষ্ট নয় গোয়েন্দাদের কাছে। আজ, মঙ্গলবার ময়না-তদন্তের পরে মৃত্যুর কারণ এবং খুনের সম্পর্কে আরও তথ্য মিলবে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। পুলিশ সূত্রের খবর, প্রতিমার ঘরের আলমারি খোলা ছিল। চাবি ঝুলছিল। তবে প্রতিমার পরিবারের লোকেরা না এলে বোঝা যাচ্ছে না, ওই ঘর থেকে কিছু খোয়া গিয়েছে কি না। তবে সারা ঘরে তল্লাশি করার পরে গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, সম্ভবত ঘরের কিছু খোয়া যায়নি।

প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জেনেছে, প্রতিমা বিবাহিত। তাঁর স্বামী দিলীপ অন্ধ্রপ্রদেশে থাকেন। তিনি সোনার কারিগর। তাঁদের দুই ছেলে। বড় ছেলে সন্দীপ ও তাঁর স্ত্রী দিলীপের সঙ্গে থাকেন। ছোট ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ভিন্ রাজ্যে চাকরি করেন। তাই প্রতিমা বছর দুয়েক ধরে একাই থাকতেন। প্রতিমার দেওর অজিত মাইতি পুলিশকে জানান, এ দিন সকাল থেকেই তাঁর দাদা প্রতিমাকে ফোন করছিলেন। কিন্তু সাড়া না পাওয়ায় ভাইকে প্রতিমার খোঁজ নিতে পাঠান। অজিতবাবু এসে দেখেন, ঘর থেকে কটু গন্ধ বেরোচ্ছে। এলাকার বাসিন্দারাও তা জানান। এর পরেই অজিতবাবু কয়েক জন বাসিন্দাকে নিয়ে একটি জানলার পাল্লায় ধাক্কা দেন। সেটি খুলে যায়। জানলা খুলতেই প্রতিমার দেহ দেখতে পান অজিত।

এলাকার বাসিন্দাদের থেকে পুলিশ জানতে পেরেছে, প্রতিমার আদি বাড়ি ঘাটালের দাসপুরে। তবে বহু দিন ধরেই তিনি ও দিলীপ পরিবার নিয়ে গিরিশ পার্কের ওই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। বছরখানেক আগে দিলীপ-সন্দীপ অন্ধ্রপ্রদেশে চলে যান। প্রতিমাও স্বামীর কাছে মাঝেমধ্যে যেতেন। প্রতিমার প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, প্রতিমার কয়েক জন পরিচিত ব্যক্তিও ওই বাড়িতে যাতায়াত করতেন। পাড়ার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ওই বাড়িতে মাঝেমধ্যে কয়েক জন পাওনাদার হাজির হতেন। কিছু দিন আগেই বাড়ির মালিক বিশ্বনাথ শ্রীমানির সঙ্গে প্রতিমার বচসাও হয়েছিল।

প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ আরও জেনেছে, ওই বাড়ির এক বাসিন্দা শনিবার রাত দশটা নাগাদ সদর দরজা বন্ধ করেছিলেন। তখন প্রতিমার ঘরে আলো জ্বলছিল। রাত দু’টো নাগাদ ফের বাইরে এলে ওই ব্যক্তি খেয়াল করেন, সদর দরজা খোলা। কিন্তু প্রতিমার ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। সে দিন প্রতিমার ঘরে কে এসেছিলেন, তা পুলিশ খতিয়ে দেখছে। যদিও প্রতিবেশীরা সে দিন রাতে কোনও চিৎকার শোনেননি বলে পুলিশকে জানিয়েছেন।

কী কারণে খুন, তা নিয়ে অবশ্য সোমবার রাত পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি তদন্তকারীরা। তাঁরা বলছেন, ঘরের আলমারি খোলা ছিল। তা থেকে অনেকেই মনে করতে পারেন, লুঠের উদ্দেশ্যেই খুন। কিন্তু মহিলার দেহ যে ভাবে মিলেছে, তাতে প্রতিশোধ নিতে যৌন নির্যাতন চালিয়ে খুনের কথাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এক গোয়েন্দাকর্তার কথায়, ‘‘তদন্তকারীদের নজর অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য আলমারি খোলা হয়ে থাকতে পারে। তবে এই ঘটনার সঙ্গে প্রতিমার পরিচিত কেউ জড়িত আছেন বলে মনে করা হচ্ছে।’’ এ দিন ঘটনাস্থলে যান লালবাজারের হোমিসাইড শাখার অফিসারেরা। আনা হয় পুলিশ কুকুরও। কুকুরটি আলমারি শুঁকে তার পরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কাছেই অন্ধগলিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। কেন কুকুরটি ওই গলিতে ঢুকল, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE