Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
কালীঘাট

...তবু না ভালবেসে উপায় নেই

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে এ পাড়ার মেয়ে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং কালীঘাটের সাবেকি বাসিন্দা। তবু, হরিশ চাটুজ্যে স্ট্রিটের বাড়িটির জন্য কালীঘাটবাসীর চোখে পড়ার মতো কোনও হেলদোল নেই।

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৫ ০০:৪৪
Share: Save:

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে এ পাড়ার মেয়ে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং কালীঘাটের সাবেকি বাসিন্দা। তবু, হরিশ চাটুজ্যে স্ট্রিটের বাড়িটির জন্য কালীঘাটবাসীর চোখে পড়ার মতো কোনও হেলদোল নেই।

আমাদের পাড়াতে, মানে কালীঘাটে দুটোই ঠিকানা। ১৩ ভগবতী লেন: মায়ের বাড়ি। আর ১১৩ টালিগঞ্জ রোড: কেওড়াতলা মহাশ্মশান। আমাদের এলাকায় সবই অলৌকিক অথবা পারলৌকিক। বকেয়াদা’দের বাড়ির তলায় চায়ের দোকানের আড্ডা, সুতরাং মন্ত্রী-সান্ত্রি সাহেব-মোসাহেব কাউকে ‘কাউন্টার’-এর মধ্যেই আনে না। কালীঘাট রোড দিয়ে গ্যুন্টার গ্রাস বা অরহান পামুক-এর মতো ঔপন্যাসিক হেঁটে গেছেন। গার্সিয়া মার্কেস পা রাখেননি। কিন্তু মার্কেসের ১০০ বছরের নিঃসঙ্গতার মাকন্দোর মতোই কালীঘাট এক অলীক জনপদ। যেন সময়ের ফাটলে আটকে থাকা উনিশ শতকের একটি মলিন টুকরো।

ভৌগোলিক ভাবে দেখলে উত্তরে ৭৩ নং ওয়ার্ডে গদাধর আশ্রম পর্যন্ত, পুরো ৮৩ নং ওয়ার্ড আর ৮৮ নং ওয়ার্ডে শ্মশান পার হয়ে তেলকল। এক দিকে টালির নালা, অন্য দিকে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোড— এটুকুই বিশুদ্ধ কালীঘাট। কিন্তু পুরসভার দলিল কালীঘাটের হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। তার নোনা ধরা গলির পাঁচিলে, চুন-সুরকির ছাদের কড়ি-বরগায়, কলতলায় কত যে মায়া! কত যে রূপকথা! এখনও এই নেপাল ভট্টাচার্য স্ট্রিটের উপগলিতে তিনটি কাঁঠাল গাছ জ্যোৎস্নায় আমাদের জানালার গরাদের ও-পারে হামি খায়। বড়লোকের ঘরে ঘুলঘুলি নেই। ফলে চড়াই লুপ্ত হয়ে গেল। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ ছাড়া এতটুকু খড়কুটো নেই কোথাও। কালীঘাটে গত বসন্তেও অ্যাসবেস্টসের চালের ফাঁকে চড়াইয়ের ডিম! খোলা জানালা দিয়ে বিছানার চাদর কেটে তৈরি পর্দা ওড়ে। কামিনী গাছের ঝাড় দেখা যায়। তাতে বুলবুলি দোল খায়। প্রায় বস্তির মতো ঘিঞ্জি পাড়ায় শিউলি গাছের মাথায় টিয়া! ঠাকুমা আর নাতি ঘরের উঠোনে বড়ি পাহারা দিচ্ছে। কিছু নতুন হাল ফ্যাশনের ফ্ল্যাটবাড়ি এ-দিকে ও-দিকে উঁকি দিচ্ছে। তবু কালীঘাটে ‘ব্লু লেগুন’ বা ‘হ্যাপি হিল’ জাতীয় কিছু সাধারণ ভাবে নেই। বাড়িতে সকালবেলা অনেকেই গামছা পরে ঘোরাঘুরি করে। গ্র্যাজুয়েট সিকিউরিটি নেই। বাড়ির নাম ‘গোবিন্দধাম’ বা ‘তারিণীভবন’। সদর দরজা খোলা। কড়া নাড়লেই শোনা যাবে ‘অ কানাই, দ্যাখ তো কে এল?’ শিবরাত্রিতে নতুন-বৌ ঠাকুরঝিকে নিয়ে নকুলেশ্বরতলায় জল ঢালতে যাবেই। বৈশাখে লোকে শীতলপাটি পেতে ছাদে বসে দখিনা হাওয়ার খোঁজে।

স্যাঁতসেঁতে মেঝে, শ্যাওলা-ধরা দেওয়াল, একটা বাড়ির দুটো ঠিকানা হয়তো— প্রথমটা কালী টেম্পল রোডের, দ্বিতীয়টা ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটের। দুপুরে ১১ ওয়াটের চিনে টিউব জ্বেলে মেজবাবু প্রণামীর খুচরো সাজাচ্ছেন। কোনটা আধুলির মনুমেন্ট, কোনটা দু’টাকার কুতুব। গিন্নি দরজায় শেকল তুলে পরিচারিকার ঘর মোছা আটকে রেখেছেন। বেচারিরও উপায় নেই, সে কালীমায়ের মন্দিরের মৌরিবাটা-সহ ও পেঁয়াজহীন মাংসের ঝোল ও খিচুড়ি ভোগ নিয়ে বাড়ি ফিরবে। ফি বছর কোথাও কিছু নেই, আকাশে শরতের সাদা মেঘ, খটখটে রোদ্দুর, কিন্তু কালীঘাটে বন্যা হবেই। আদিগঙ্গা উপচে পড়ে। দশকর্মা ভাণ্ডার হাঁড়িকুড়ি সামলায়, মুদি দোকান চালের বস্তা দোতলার পাটাতনে তোলে, উকিলবাবুকে চেয়ারে চড়িয়ে মক্কেল বড় রাস্তার মোড় পর্যন্ত কাঁধ দেয়। আজ আলিপুরের সেরেস্তায় অ্যাপিয়ার না করলেই নয় যে! জল সরে গেলে রাজপথ নরম ছানার মতো থকথকে পলিতে আচ্ছন্ন। সে সময় পথচারীদের দেখলে বোঝা যায়, নৃত্যশিল্পে কালীঘাটের নৈপুণ্য কত মর্মস্পর্শী! অবশ্য এমন বন্যা রোজ রোজ হয় না। শ্রাবণের শেষ থেকেই লোকে পঞ্জিকায় জোয়ার-ভাটা দেখে অনুমান করে ষাঁড়াষাঁড়ির বান কবে আসবে! তখন ক্যাজুয়াল লিভের দরখাস্ত জমা পড়ে। লিভ নেই। নির্বাচনের আগে তাঁরা দুজনেই সুহাসিনী, সুমধুরভাষিনী। আমরা অল্প কথাতেই বুঝি, এ সব জাতীয় সমস্যায় আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের সহায়তা দরকার। তবু সুরেন বাঁড়ুজ্যে রোড যখন আছে, তাঁদের চেষ্টায় খামতি থাকবে না। নির্বাচনের পরে এত কথা তাঁদের মনে থাকে না। তা ছাড়া ‘মালিকা পরিলে গলে প্রতি ফুলে কেবা মনে রাখে?’ আর আছে আমাদের গৌরবগাথা: ম্যালেরিয়া! এই কলমচি চার বার ভুগে ওঠার পর স্থানীয় চিকিৎসক বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘‘কী যে সেকেলে ভাইভ্যাকস ম্যালেরিয়ায় পড়েন, বুঝতে পারি না!’’ অগত্যা পরিবার ও প্রতিবেশীর মান রাখতে স্ত্রী-পুত্রের জন্য একেলে ফ্যালসিফেরাম ম্যালেরিয়া বরাদ্দ করি। তবে বলতেই হবে, দুধওয়ালা পার্কের পাশে কর্পোরেশন পরিচালিত ক্লিনিকটি খুবই উন্নত পরিষেবা দিয়ে থাকে। অষ্টমীর দিন সকালেও তাদের দরজা খোলা দেখে ভাবি— ‘মা আছেন আর আমি আছি, ভাবনা কি আর আছে আমার?’

আসলে কালীঘাটের জীবনে খুব চমকপ্রদ, খুব হ্যাপেনিং কিছু ঘটে না। ছেলের বউ সন্তানসম্ভবা হলে সাধ ও সত্যনারায়ণ পুজোয় সিন্নি দেওয়া হয়। রাস্তার মোড়ে প্রকাশ্য তর্কযুদ্ধে ‘মলমাসে ক’টি অমাবস্যা’ বলতে না পেরে পুরোহিত হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা বর্জন করে স্থানীয় প্রৌঢ় পাইস হোটেল খোলেন। এখানে হনিমুন করতে কেউ চট করে ব্যাঙ্কক চলে যায় না। দিনকাল তবু পাল্টায়। আমাদের পাড়ায়ও লোকে মোবাইলে কথা থামানোর আগে ‘টা-টা’ বলে। হাফপ্যান্ট পরে বাজার থেকে ক্যারিব্যাগ হাতে ‘চিকেন’ নিয়ে ফেরে। দোতলা শরিকি বাড়ি ভেঙে ছ’তলা পায়রার খোপ ওঠে। আর সেই সব ফ্ল্যাটে যাঁরা নতুন আসেন, তাঁদের সঙ্গে চোখাচোখি হয় না ছেষট্টি পল্লির পুরনো বাসিন্দাদের। শ্রেণিসংগ্রাম বলতে এটুকুই কালীঘাটে। রথ, ঝুলন, রাস পড়তির দিকে। সরস্বতী পুজো কিছুটা কোচিং সেন্টারে, কিছুটা অটো স্ট্যান্ডে। এলাকার ইস্কুলগুলো অন্তর্জলী যাত্রায়! আর দুর্গাপুজো চলে গেছে স্পনসরদের হাতে। একটা সাইকেল চলতে পারে না সেই গলির মুখে আকাশ-ছোঁয়া প্যান্ডেল। পুলিশ কৌতূহলী হয়ে উঠলে উদ্যোক্তারা জানিয়ে দেন, ‘‘বডি বেরিয়ে যাবে ঠিক।’’ আগুন লাগলে— বলতে নেই, তল্লাটের পর তল্লাট জতুগৃহ। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ভিড় মেপে আর লাভ হবে? দমকল ঢুকবে কোথায়? যাক, ছোট মাথায় বড় চিন্তা না আসাই ভাল।

অলিতে-গলিতে কুকুর। তারা চোরকে চুরি করতে বলে, গৃহস্থকেও সজাগ থাকতে বলে। সে দিন দেখি, একদল বিহারি তীর্থযাত্রী কালী লেনের সারমেয়কুলকে দেখে ভয় পাচ্ছে। স্থানীয় এক যুবক তাঁদের আশ্বাস দেয়, ‘‘আপলোগ যাইয়ে। ডরো মাত। এ কুত্তা সারে শাকাহারী হ্যায়!’’ কুকুরের নিরামিষ ভোজনের সঙ্গে পুণ্যার্থীদের পা কী ভাবে যুক্ত, সে যুক্তি কালীঘাটে না থাকলে বোঝা দুষ্কর। সেই কবে মরাঠা বর্গিদল মায়ের মন্দিরের সামনে থমকে দাঁড়িয়েছিল— এখন কালীঘাটের মুখে বুড়ি পিসিমার চামড়ার মতো অজস্র সময়ের দাগ। তার শপিং মল হয়নি, কালীঘাটে কোনও ‘শিল্পলায়ন’ নেই, তার সুইমিং পুল নেই।

আমার পাড়া ভাঙা কার্নিশের প্রান্তে বেড়ে ওঠা অশ্বত্থ চারার মতো উদ্বৃত্ত; উচ্চাশাহীন।

কালীঘাট বাজারের দিন গেছে— আমাদের জন্য যেন বাস্তুহারা বাজার। ‘নিসর্গের আসল সৌন্দর্য থাকে তার বিষাদে’, ইস্তাম্বুল বিষয়ে লেখাটির প্রস্তাবনায় উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন পামুক।

ক্ষয়ে যেতে যেতে কালীঘাট আমার গহনে চুঁইয়ে পড়ে রক্তের ফোঁটার মতো। এ পাড়াকে না ভালবেসে আমার উপায় নেই।

লেখক ফিল্ম স্টাডিজের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE