প্রস্তুতি: ছাত্র মকবুল ও কাজীর সঙ্গে প্রতিমার সাজ সম্পূর্ণ করছেন দীনেশবাবু (বাঁ দিকে)। সোমবার, হাওড়ার বাড়িতে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
ছাত্রছাত্রীরা মাটি না আনলে মূর্তি গড়তে হাত সরবে না মাস্টারমশাইয়ের। পুজোর পর থেকেই ফোন যাবে, ‘ওরে কাজী... কী রে সৌরভ, জানিস তো বছরে এই একটিই ঠাকুর গড়ি। আমার সরস্বতী তিলে তিলে তৈরি হতে সময় লাগে! তাড়াতাড়ি আন মাটিটা!’
স্নেহধন্যদের নামগুলো হয়তো পাল্টে পাল্টে যায়। তবে এমনটাই ঘটে! ঘটে আসছে আজ ৫৪ বছর। অতিমারির দিনেও এই নিয়মের অন্যথা হয়নি। সরস্বতী পুজোর বেশ খানিকটা আগে, রাসপূর্ণিমার শুভ দিনে তাঁর সরস্বতীর কাঠামোয় হাত দিয়েছিলেন সেন্ট পলস কলেজের বাংলার অবসরপ্রাপ্ত মাস্টারমশাই দীনেশকুমার খান। তবে এই ৭৫ ছুঁই ছুঁই বয়সে টের পাচ্ছেন, কাঠামোয় খড় বাঁধার সময়ে হাতের ঢিলে হওয়া চামড়ায় টান পড়ছে। ব্যথা করছে। তাই পাড়ার চেনা মুখ, দেওঘর-মধুপুর থেকে আসা দেহাতি রাজমিস্ত্রিদের ডেকেছেন, ‘‘তোরা দড়ি বাঁধতে আমায় সাহায্য কর না বাবা!’’ পঙ্কজ, বালেশ্বরেরা ‘মাস্টারমশাই’ বা ‘গুরুজি’কে বলেন, ‘‘জানেন, ছোট জাত বলে দেশে কেউ এ সব করতে ডাকে না।’’ শুনে লজ্জায়-গ্লানিতে ‘দীনেশ স্যরের’ মুখটা কেমন ছোট হয়ে যায়।
কৈশোর শেষে বাড়ির সরস্বতী পুজোয় প্রতিমা গড়ার খেয়ালটা শুরু হয়েছিল তুতো ভাই-বোনদের আবদারে। পরে শিক্ষকতা শুরু করার পরে তাতে যোগ হয়েছে অন্য অভিজ্ঞান। হাওড়ার বৃন্দাবন মল্লিক লেনে অকৃতদার ‘দীনেশ স্যরের’ বাড়ির সরস্বতী পুজো এখন ধর্মের মিলনমেলা। এ বছর সরস্বতী পুজো খানিক নিচু তারে বাঁধা। তবে ছাত্রছাত্রীদের পরিবার, পাড়ার লোক মিলিয়ে খিচুড়ি-ভোগ, অঞ্জলির আনন্দে এই পুজোর বরাবরই আলাদা মহিমা।
মা-বাবাকে প্রথমেই দীনেশ বলে দিয়েছিলেন, ‘‘দেখ, আমার কাছে তো ছাত্রের একটাই ধর্ম, সে ছাত্র। আমার সরস্বতী পুজোও তাদের বাদ দিয়ে পূর্ণ হবে না!’’ সেন্ট পলসের মাস্টারমশাইয়ের মুসলিম, খ্রিস্টান ছাত্রেরা তার পরেই জড়িয়ে গিয়েছেন এই পুজোয়। তাঁরা এই পুজোয় কেউ প্রতিমার মাটি জোগান, কেউ এগিয়ে আসেন নারকোল, ফল নিয়ে। উলুবেড়িয়ার বাসিন্দা, বিশ্বভারতীতে পিএইচডি স্তরের গবেষক কাজী আবু জ়ুম্মান যেমন বলেন, ‘‘শ্রীরামকৃষ্ণের যত মত, তত পথ কথাটার একটা ফলিত প্রয়োগ দেখি স্যরের জীবনে।’’ প্রতিমার মাটি ছাড়াও নারকোল নিয়ে এগিয়ে এসেছেন তিনি।
সেই নারকোলের নাড়ুর জন্য খেজুর গুড় এসেছে পাথরপ্রতিমার রাক্ষসখালি গ্রাম থেকে। পেশায় স্কুলশিক্ষক, দীনেশ স্যরের আর এক ছাত্র, প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান সৌরভ মাজি গুড় পাঠিয়েছেন। সৌরভ বলছিলেন, ‘‘আমপানের পরে আমার খবর নিতে স্যর অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। পরে এই করোনাকালেও এসে দেখা করে যান।’’ দেড় দশক বাদে সৌরভ এ বছরই সরস্বতী পুজোয় থাকতে পারছেন না। তবে স্যরের ঠাকুর গড়ার মাটি তিনি সময় মতোই পাঠিয়ে দিয়েছেন। দীনেশবাবুর আর এক কৃতী ছাত্র, সেন্ট পলসের শিক্ষক শেখ মকবুল ইসলাম থাকেন পাশের বাড়িতেই। তিনি জগন্নাথ-গবেষক হিসেবে সুপরিচিত। মুক্তকণ্ঠে বলেন, ‘‘আমার নির্মাণ, মানুষকে সব ধর্মের বাইরে ভালবাসতে শেখা, স্যরের ছোঁয়াতেই গড়ে উঠেছে।’’
কিন্তু ধর্মকে ঘিরে বিভেদের দিনকালে, কতটুকু মূল্য এই একযোগে সরস্বতী পুজোর?
খানিক উস্কে দেওয়া প্রশ্নে দীনেশ স্যর স্মিত হাসেন, ‘‘কলেজে পড়ানোর সময়ে পার্ক সার্কাসে কত ছাত্রের বাড়িতে নিয়মিত গিয়েছি। ৬২-৬৩ বছরের বুড়ো ছাত্রেরাও নিয়মিত খবর নেন। আমাদের ভাব-ভালবাসা একটি দিনের নয়।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এ শুধু পুজো নয়। রি-ইউনিয়ন! পুজো একটা উপলক্ষ। ভিড়টা ক্রমশ বেড়েছে। কম দিন তো নয়, দশকের পর দশক এমনটাই হয়ে আসছে।’’ আজকের দিনে ধর্ম আর রাজনীতির খিচুড়ির সঙ্গেও দীনেশ স্যরের সরস্বতীর খিচুড়ির ঢের ফারাক। মাস্টারমশাই বলেন, ‘‘পুজো, মন্দির নিয়ে রাজনীতি ভাল লাগে না! ধর্ম মানে কি শুধু মন্দিরে ঘণ্টা নাড়া বা নমাজ পড়া?’’
ছাত্রছাত্রীদের মুখগুলো ভাবলে এই বয়সেও প্রতিমা গড়ার নেশায় রক্তে টান ধরে প্রবীণ শিক্ষকের। পুজোর সাত দিন আগেই চোখ এঁকে ফেলেছেন এক টানে। কাজী, মকবুলেরা রাতদিন স্যরের বাড়িতেই পড়ে। সবাইকে বেঁধে রেখেছে সবার স্পর্শে জীবন্ত সরস্বতীর টান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy