Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

লাল বাতিতে থেমে নয়, ওঁরা গানের ও-পারে

ট্র্যাফিকের আলো লাল হতেই, কাচ তোলা গাড়ির জানলায় দু’-দশ টাকার জন্য উঁকিঝুঁকি মারা, কারও বাড়িতে বাচ্চা হওয়ার খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে নাচ-গান করা— এই ছিল ওঁদের জীবন। শাড়ি, সালোয়ার পরা বৃহন্নলা ওঁরা। উল্টো দিকের চোখে উপেক্ষা, অসম্মান কখনও ঘৃণা দেখতে দেখতে চোখ সয়ে এসেছে ওঁদের। ভবিতব্য হিসেবে মেনে নিয়েছেন ওঁরা অবহেলাকে।

পাশে: দুই দিদিমণির সঙ্গে ওই বৃহন্নলারা। নিজস্ব চিত্র

পাশে: দুই দিদিমণির সঙ্গে ওই বৃহন্নলারা। নিজস্ব চিত্র

সুনন্দ ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৯ ০৪:০৮
Share: Save:

বর্ষার গানে মঞ্চ আলো করে নেচে চলেছেন জনা পাঁচেক। একই সঙ্গে মঞ্চের এক পাশে রাখা বড় ক্যানভাসে তুলির আঁচড়ে বৃষ্টিস্নাত গ্রাম বাংলার ছবি ফুটিয়ে তুলছেন দু’জনে। দর্শক মোহিত হয়ে দেখছেন তাঁদের। গান, নাচ, আঁকা শেষে হাততালি দিয়ে উঠছেন তাঁরা। সেই হাততালি আর অভিবাদন পেয়ে মিঠু, মনোরমা, শিল্পার চোখ চকচক করে ওঠে। এত দিনের ‘দূর-ছাই’ করা জীবনটাকে অনেক পরিশ্রমে তাঁরা টেনে এনেছেন এই সম্মানের আলোয়।

ট্র্যাফিকের আলো লাল হতেই, কাচ তোলা গাড়ির জানলায় দু’-দশ টাকার জন্য উঁকিঝুঁকি মারা, কারও বাড়িতে বাচ্চা হওয়ার খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে নাচ-গান করা— এই ছিল ওঁদের জীবন। শাড়ি, সালোয়ার পরা বৃহন্নলা ওঁরা। উল্টো দিকের চোখে উপেক্ষা, অসম্মান কখনও ঘৃণা দেখতে দেখতে চোখ সয়ে এসেছে ওঁদের। ভবিতব্য হিসেবে মেনে নিয়েছেন ওঁরা অবহেলাকে।

এই অবস্থায় মঞ্চ আলো করে তাঁদের উপস্থিতি, তা-ও আবার রবীন্দ্র গান-কবিতা-নৃত্যে! মিঠু দত্তের কথায়, ‘‘জানি না, ভবিষ্যৎ কী? কিন্তু, চারটে শো হয়েছে। এত দিন ধরে যাঁরা অবহেলা

করেছেন, তাঁরাই হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছেন। বলতে পারেন, জীবনের একটা মানে খুঁজে পেয়েছি।’’ মনোরমা দাস আবার ছোট থেকেই অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর জন্মগত শারীরিক গঠন এনে ফেলেছে অন্য পেশা, ‘বাধাই’-এ। অর্থাৎ সদ্যোজাত শিশুকে আশীর্বাদ করে টাকা রোজগার করার কাজ। মনোরমার কথায়, ‘‘সুযোগ থাকলে ওই পেশা ছেড়ে বাকি জীবনটা অভিনয়, নাচ করে কাটিয়ে দিতে চাই।’’

তবে শিল্পা মণ্ডলের কথায় কিছুটা বাস্তবের ছোঁয়া— ‘‘শুধু মঞ্চে নাচ বা অভিনয় করে পেট তো ভরবে না। বাধাইয়ের কাজ করে যেতে হবে আমাদের। তবে, পাশাপাশি এটা চললে সামাজিক যে সম্মান পাব, সেটা আমাদের জরুরি। এতটা অবহেলা, উপেক্ষা আমাদের সম্ভবত প্রাপ্য নয়।’’

গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত — এই ছয় ঋতুকে পরপর সাজিয়ে রবীন্দ্রগানে ঋতুরঙ্গ পরিবেশন করছে ‘রবিচ্ছায়া’ নামে এক সংগঠন। সেখানেই দুর্গা সাজছেন মনোরমা। শিল্পা ‘হিমের রাতে’-র সঙ্গে নেচে উঠছেন। মিঠু ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলছেন বর্ষা। আর ওঁদের খুঁজে বার করে, তালিম দিয়ে সম্মানজনক জীবনে টেনে তুলে এনে ক্রমাগত উৎসাহ দিয়ে চলেছেন এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের দুই দিদিমণি — সুদেষ্ণা সান্যালরুদ্র এবং রিমা পাল। সুদেষ্ণা নাচের শিক্ষিকা, রিমা আঁকার। রবিচ্ছায়া সুদেষ্ণাদেরই সংগঠন।

কী করে পেলেন ওঁদের?

সুদেষ্ণা জানিয়েছেন, কোনও এক জৈষ্ঠ্যের দুপুরে পার্ক সার্কাস মোড়ে কাচ তোলা গাড়ির ভিতর থেকে এমনই এক মিঠুকে দেখে মনে হয়, ওঁদের রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের সঙ্গে যুক্ত করলে কেমন হয়? সুদেষ্ণা নিজে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। নাচও করেন। নিজে বহু জায়গায় অনুষ্ঠান করেছেন। রিমাকে সঙ্গে নিয়ে শুরু হয় খোঁজ। কখনও উল্টোডাঙার কাছে দক্ষিণদাঁড়ি, কখনও কাঁচরাপাড়া। জনে জনে গিয়ে অনুরোধ করেছেন। সুদেষ্ণার কথায়, ‘‘প্রথম যখন গিয়ে ওঁদের জিজ্ঞেস করেছি, ‘আমাদের সঙ্গে নাচের অনুষ্ঠান করবেন?’ তখন অবাক চোখে দেখেছেন। কেউ কথা দিয়ে এসে মহড়া দিয়েও চলে গিয়েছেন। কিন্তু

ফিরে আসেননি।’’

ভানু নস্কর, টুবু সরকার, সোনালি রায়, বিটন দাসদের নিয়ে দলে এখন ১৭ জন। দেড় বছর ধরে মহড়া দিয়ে, ইতিমধ্যেই আমন্ত্রণে তিনটি শো করে ফেলেছেন তাঁরা। সুদেষ্ণা ও রিমা জানিয়েছেন, তাঁদের নিজেদের সন্তানেরাও ওঁদের সঙ্গে মঞ্চে অংশ নিচ্ছে। উদ্দেশ্য, কখনও যেন মিঠুদের মনে না হয়, ওঁরা ব্রাত্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Eunuch Drama Transgender
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE