সানি চৌধুরী এবং রবি সিংহ
পড়শির বাড়ি থেকে পায়রা চুরির অভিযোগে সারা পাড়া ঘুরিয়ে রাস্তায় ফেলে পেটানো হয়েছিল দুই বালককে। চোর অপবাদে পাড়াছাড়া করার হুমকিও দেওয়া হয় তাদের এক জনকে। অভিযোগ, এর কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজের ঘরের সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার হয় সেই বালকের দেহ। মঙ্গলবার ঘটনাটি ঘটেছে কসবার নস্করহাটের পূর্বশ্রীপল্লিতে। পুলিশ জানায়, সানি চৌধুরী (১১) নামে ওই বালকের বাবার অভিযোগের ভিত্তিতে দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযুক্ত আরও এক জন পলাতক। এ দিকে, এই ঘটনাকে ঘিরে বুধবার বিকেল থেকে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন স্থানীয়েরা। শ’পাঁচেক বাসিন্দা মিলে মৃতদেহ নিয়ে রাত পর্যন্ত অবরোধ করেন পিকনিক গার্ডেন রোড। পুলিশের দাবি, ধৃত রঞ্জন সেন ও রণজিৎ সেনের বাড়ি ভাঙচুরের চেষ্টা করতে গেলে আটকানো হয় ক্ষুব্ধ জনতাকে। দু’পক্ষের গোলমালের সময়ে ছোড়া ইটের আঘাতে আহত হন দুই পুলিশকর্মী। এর জেরে রাত পর্যন্ত ওই এলাকায় প্রবল যানজট হয় বলেও জানায় পুলিশ।
স্থানীয় সূত্রে খবর, নস্করহাটের বাসিন্দা বৃদ্ধ দম্পতি রঞ্জন ও গৌরী সেন পায়রা পোষেন। মঙ্গলবার সকালে উঠে তাঁরা দেখেন, ঘরে একটি পায়রা নেই। এর পরেই রঞ্জন, গৌরী এবং তাঁদের ছেলে রণজিৎ সেন মিলে প্রতিবেশী বালক সানিকে ডেকে নিয়ে এসে রাস্তায় ফেলে ব্যাপক মারধর করেন। অভিযোগ, মারধরের চোটে ওই বালকের কান দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে। পুলিশ জানিয়েছে, ওই বালক বারবার বলতে থাকে যে সে চুরি করেনি। কিন্তু তা শোনার জন্য থামেননি প্রতিবেশীরা। এমনকী, পাশের ধোপারমাঠ থেকে খোয়া যাওয়া পায়রাটি উদ্ধারের পরেও থামেনি মারধর। এতেই শেষ নয়। এলাকার বাসিন্দারা জানান, এত কিছুর পরে বিকেল তিনটে নাগাদ বাড়ি ফিরে সানি খেতে বসলে সেখানে ফের উপস্থিত হন গৌরী। এক প্রতিবেশীর অভিযোগ, ‘‘সানিকে চোর বলে সম্বোধন করে সারা পাড়া জুড়ে চিৎকার করেন গৌরী। সানির বাবা-মা বাড়িতে এলে পুরো ঘটনার কথা জানিয়ে তাদের পাড়া ছা়ড়ারও হুমকি দেন তিনি।’’
পুলিশ সূত্রে খবর, মঙ্গলবার দুপুরে ঘটনার সময়ে ধোপাপাড়ায় স্থানীয় বালক রবি সিংহের সঙ্গে খেলছিল সানি। বুধবার রবি বলে, ‘‘আমরা খেলছিলাম। হঠাৎ একটি পায়রা আমাদের কাছে উড়ে আসে। আমরা পায়রাটি ধরে রাখি। কিন্তু সেটি আমরা কখনওই চুরি করিনি। বরং আমরা পায়রাটি রঞ্জনবাবুর বাড়িতে দিয়েই এসেছিলাম। পায়রাটি তাঁর হাতে দেওয়ার পরেও আমাদের মারধর করা হল!’’
মর্মান্তিক: ছেলের মৃত্যুর পরে ভেঙে পড়েছেন সানির মা অঞ্জলিদেবী (মাঝে)। ছবি: রণজিৎ নন্দী
স্থানীয় সূত্রে খবর, বছর ছয়েক ধরে পূর্বশ্রী পল্লিতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে সপরিবার বসবাস করেন পেশায় আনাজ বিক্রেতা শত্রুঘ্ন চৌধুরী।
তাঁর স্ত্রী অঞ্জলি চৌধুরী পরিচারিকার কাজ করেন। তাঁদের ছেলে সানি স্থানীয় একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত। সানির এক ছোট বোন আছে। পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার সময়ে সানির বাবা-মা বাড়ির বাইরে ছিলেন। বাড়িতে ছিল সানির বোন। সাড়ে তিনটে নাগাদ
সে দেখে, সানির ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। জানলা দিয়ে দাদাকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পেয়ে প্রতিবেশীদের জানায় সে। প্রতিবেশীরা ঘরের দরজা ভেঙে তাকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখেন। পুলিশ এসে দেহটি উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
এই ঘটনার খবর জানাজানি হতেই চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে পাড়া জুড়ে। অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তির দাবিতে সরব হন প্রতিবেশীরা। বুধবার বিকেলে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, রঞ্জন সেনের তিনতলা বাড়ি তালাবন্ধ। পাড়ার লোকেরা অভিযুক্তদের শাস্তির দাবি তুলে জড়ো হয়েছেন তাঁদের বাড়ির সামনে। এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে বিশাল পুলিশ বাহিনী। সানিদের বাড়ির মালিক বাবু বসু বলেন, ‘‘ছ’বছর ধরে সানি আমার বাড়িতে রয়েছে। ও খুব ভাল ছেলে। ওকে যে ভাবে পায়রা চুরির অপবাদে মারা হল, তা ভাবাই যায় না। ও চুরি করতেই পারে না।’’ স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, রঞ্জন সেন নিজের বাড়ির ছাদে পাখি রাখেন। স্থানীয় বাসিন্দা বিষ্ণু দাসের অভিযোগ, ‘‘বছর তিরিশ আগে একই ভাবে হাঁস চুরির মিথ্যা অভিযোগে রঞ্জন আমাকে ব্যাপক মারধর করেছিলেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy