Advertisement
E-Paper

লড়াই ঘরেও, টের পাচ্ছে বিধাননগর

ভোটযুদ্ধের প্রাক্‌-সন্ধ্যায় সল্টলেকে রাজ্যের এক মন্ত্রীর ডেরা। চলছে শাসক দলের কর্মীদের ইতস্তত আড্ডা। সেখানে কথাটা উঠতেই চার দিক থেকে ফিকফিক হাসি। প্রশ্ন ছিল— বিধাননগর পুর নিগমের মেয়র তা হলে কে হচ্ছেন?

অনুপ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৫৫
সব্যসাচী দত্ত ও কৃষ্ণা চক্রবর্তী।

সব্যসাচী দত্ত ও কৃষ্ণা চক্রবর্তী।

ভোটযুদ্ধের প্রাক্‌-সন্ধ্যায় সল্টলেকে রাজ্যের এক মন্ত্রীর ডেরা। চলছে শাসক দলের কর্মীদের ইতস্তত আড্ডা। সেখানে কথাটা উঠতেই চার দিক থেকে ফিকফিক হাসি।

প্রশ্ন ছিল— বিধাননগর পুর নিগমের মেয়র তা হলে কে হচ্ছেন?

উত্তরে এক প্রবীণ কেটে কেটে যা বললেন, শুনতে রসিকতা হলেও আসলে গভীর তার তাৎপর্য। বললেন, ‘‘গেরো একটাই, এক আকাশে কিন্তু দু’টো সূর্য থাকবে না!’’

নাহ্‌! বামেদের মেয়র পদপ্রার্থী অসীম দাশগুপ্তকে নিয়ে মোটেও ভাবছেন না আত্মবিশ্বাসী তৃণমূল

কর্মীরা। তাঁদের যাবতীয় অঙ্ক কষা চলছে ওই ‘দুই সূর্য’কে নিয়ে। এক জন, নিউটাউনের বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত।

অন্য জন বিধাননগরের সাবেক পুর-চেয়ারপার্সন কৃষ্ণা চক্রবর্তী। তৃণমূলের অন্দরের খবর যাঁরা রাখেন, তাঁরা জানেন দু’জনের সম্পর্ক যথেষ্টই ‘মধুর’!

এবং দু’জনেই মেয়র হওয়ার ‘খোয়াব’-এ মশগুল।

এখানেই ওই প্রবীণের কথার মাহাত্ম্য! সল্টলেকের আম তৃণমূল কর্মীদের একাংশ সাফ বলছেন, এক জনের রাস্তা একমাত্র তখনই পরিষ্কার হবে, যখন অন্য জন হারবেন। পাকা খেলুড়ে দুই নেতা-নেত্রীই নাকি মোক্ষলাভের লক্ষ্যে একের পর এক ‘দাবার চাল’ দিয়ে চলেছেন। আর তাতে বিস্তর রগড় দেখছেন দলের ভেতরের লোকেরাই।

কেমন ‘দাবার চাল’? কান পাতলে তারও দু’-একটা নমুনা টের পাওয়া যাচ্ছে। শুক্রবার সন্ধেয় শাসক দলের স্থানীয় এক পাকা চুল নেতা সহাস্য শোনালেন ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের কিস্সা।

সেখানে নাকি কংগ্রেস কর্মীরা হঠাৎ রহস্যজনক ভাবে একটু বেশিই তৎপর হয়ে পড়েছেন। বাড়ি বয়ে গিয়ে গিয়ে বলে আসছেন, ‘‘মনে থাকে যেন, টিপতে হবে এক নম্বর বোতামটাই!’’ এক নম্বরে কিন্তু কংগ্রেস প্রার্থীর নাম নেই। সেখানে রয়েছে বিজেপি প্রার্থীর নাম। তাঁর হাত শক্ত করতেই নাকি ২৯ নম্বরের কংগ্রেস কর্মীরা আদাজল খেয়ে লেগেছেন। উদ্দেশ্য একটাই— তৃণমূলকে হারানো। ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী কে? কৃষ্ণাদেবী স্বয়ং! তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের অভিযোগ, গোটা চক্রান্তটার পেছনে কলকাঠি নাড়ছে তৃণমূলেরই একটি শিবির!

প্রকাশ্যে কৃষ্ণাদেবী নিজে এই চক্রান্তের তত্ত্ব উড়িয়ে দিচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বিদায়ী পুর-চেয়ারপার্সন বলছেন, ‘‘দেখবেন, মানুষের সমর্থন নিয়ে এ বারও ঠিক জিতব!’’

মেয়র হওয়ার দৌড়ে তাঁর অঘোষিত প্রতিদ্বন্দ্বী সব্যসাচী লড়ছেন ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে। সল্টলেক ভোটব্যাঙ্কের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক, অবাঙালি ভোটারদের বড় অংশ তাঁর বিশেষ ভক্ত বলে শোনা যায়। এমনকী কোনও এক নির্বাচনী সভায় তাঁরা রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন

মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের কাছে সব্যসাচীর হয়ে দরবার করেছিলেন বলেও খবর। কিন্তু দলের দু’টি গোষ্ঠী নাকি সব্যসাচীকেই ‘পথের কাঁটা’ ঠাউরে তলে তলে অন্য খেলা খেলছে। ভোট সমীক্ষকদের ধারণা, আজ, শনিবার ভোটে তার প্রভাব পড়বে। সব্যসাচী শুনে হাসছেন, ‘‘আমি কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি? চোখ-কান সব খোলা আছে।’’

চোখ-কান খোলা রাখতে হচ্ছে শাসক দলের আরও কয়েক জন প্রার্থীকেও। সূত্রের বক্তব্য, তুলসী সিংহরায়, অনিতা মণ্ডল, জয়দেব নস্কর

বা সুধীর সাহার মতো তৃণমূল প্রার্থীরা জেনেই গিয়েছেন, দলের ‘অন্তর্দ্বন্দ্ব’ তাঁদেরও পথের কাঁটা। যেমন, ৪১ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের প্রার্থীকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছেন নির্দল প্রতীকে দাঁড়ানো দীর্ঘদিনের তৃণমূল কাউন্সিলর অনুপম দত্ত। কে ‘আসল তৃণমূল’, তা নিয়েই জমেছে তরজা। তবে খোদ মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ওই ওয়ার্ডে দলের ‘অফিশিয়াল’ প্রার্থী অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়কে জেতাতে মরিয়া।

মোদ্দা কথা, শাসক দলের বিভিন্ন প্রার্থীর টিমমেটরা বিরোধীদের নিয়ে যতটা না চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি ভাবিত দলের ‘বিভীষণদের’ নিয়ে। তবু তৃণমূলের তরফে জানানো হচ্ছে, ভোটে যে কোনও রকম ‘অন্তর্ঘাত’ রুখতে তাদের নেতা-কর্মীরা সতর্ক। ইসি ১৯৬ ঠিকানায় একটা ডেরাও হয়েছে তৃণমূলের। সেখানে নেতা-মন্ত্রীরা নাকি সশরীরে থাকবেন। ওই ডেরা থেকেই বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডের ভোট ‘নিয়ন্ত্রণ’ করা হবে বলে জানা যাচ্ছে।

গত লোকসভা ভোটেও সাবেক বিধাননগর পুরসভার অন্তর্গত ২৫টি ওয়ার্ডের ফলাফলের নিরিখে বিজেপি একাই ১৮টিতে এগিয়ে ছিল। বামফ্রন্ট এগিয়ে ছিল ৪টিতে, তৃণমূল মাত্র ৩টিতে। তবে সেই প্রসঙ্গ উঠলেই শাসক দলের পোড়খাওয়ারা ‘ও সব হিসেব এখন অতীত’ বলে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তৃণমূলের জেলা পর্যবেক্ষক তথা রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক দৃঢ় ভাবে আশার বাণী শোনাচ্ছেন। তাঁর দাবি, ৪১-০ হচ্ছেই! নবগঠিত বিধাননগর পুর নিগমে সল্টলেক, সাবেক রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভা বা মহিষবাথান পঞ্চায়েত এলাকার ওয়ার্ডগুলি— কোথাওই নাকি শাসক দলকে ঠেকানো যাবে না।

এ বার তৃণমূলের কোনও নেতা কেন্দ্রীয় ভাবে সমস্ত ওয়ার্ডের নিয়ন্ত্রণ করছেন না। অলিখিত পোর্টফোলিও ঠিক করা আছে। বিধায়ক সুজিত বসুর দায়িত্বে ছ’টি ওয়ার্ড— ৩০, ৩৩, ৩৫, ৩৬, ৩৮ এবং ৩৯। জ্যোতিপ্রিয়র নজর রয়েছে ২৮, ৩২, ৪০ এবং ৪১-এর দিকে। ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী দেবাশিস জানাকে বাইরে থেকে সাহায্য করছেন সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী। কৃষ্ণা চক্রবর্তী, সব্যসাচী দত্ত ও মিনু দাসচক্রবর্তীরা অবশ্য লড়ছেন নিজেদের জোরেই।

অতীতে বহু গোলমাল দেখেছে সল্টলেকের ভোট। যেমন দত্তাবাদ। এই এলাকার মানুষজনের চোখেমুখে এখনও কেমন একটা চাপা আতঙ্ক। ভোটের দু’রাত আগে থেকেই এ বার ওই তল্লাটে শাসক দল ছাড়া অন্য কারও পতাকা, ব্যানার বা হোর্ডিং ‘ভ্যানিশ’। স্থানীয় বাসিন্দাদের কারও কারও চাপা স্বর, ‘ওরা সব খুলে নিয়েছে।’ ‘ওরা’ কারা? শুনে সবাই নিরুত্তর। ভারতীয় বিদ্যাভবন স্কুল এবং শ্যামলী আবাসনের কাছে বিদ্যাধরী স্কুলে ভোট ‘লুঠ’ হতে পারে বলে মনে করছে তৃণমূলেরই এক বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী। শুনে স্থানীয় বিধায়ক সুজিত বসুর কটাক্ষ, ‘‘নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকাই তো মনে হবে!’’ স্থানীয় সিটিজেন্স ফোরাম অবশ্য ভোটে সন্ত্রাস রুখতে মাঠে নামার ইঙ্গিত দিচ্ছে। যদিও শ্রাবণী আবাসনের এক বাসিন্দা বললেন, ‘‘ভোটের দিনে বোমাবাজি-হুমকি এ বার মনে হচ্ছে বাম আমলের পরম্পরাকেও ছাপিয়ে যাবে।’’ দত্তাবাদ এলাকায় তিন বারের জয়ী, সিপিএমের রাধানাথ চন্দও খানিক আতঙ্কিত, ‘‘জানি না, শনিবার কী হবে!’’

শাসক দলের এমন দাপটের পটভূমিতে বেজায় খচখচ করছে অন্তর্কলহের কাঁটাটা। এ বার প্রবল মোদী-হাওয়া নেই। সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল বিজেপি অনেকটা ব্যাকফুটে। তবু তৃণমূলের একটি গোষ্ঠীরই আশঙ্কা, ৪০ ও ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে ‘সেমসাইডে’ই না মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে বিজেপি।

বাইরের চেয়ে ঘরের লড়াইটাও তাই কম মাথাব্যথা নয়!

saltlake resident saltlake seeing tmc leaders krishna chakraborty sabyasachi dutta saltlake tmc group rivalry bidhannagar municipality election saltlake vote
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy