যত্রতত্র: হাওড়া সাবওয়ের কাছে প্রকাশ্যেই প্রস্রাব।
‘শুনিনি কলকাতা ছেড়ে গেছে কেউ আর ভাল আছে…’।
কিছু দিন আগে পর্যন্ত এই লাইনটা আমার ফেসবুকের কভারে ফিরে ফিরে আসত। আসত, কারণ এর চেয়ে নির্মম সত্যি আর কিছু হয় না। সেই ২৫ বছর বয়স থেকে কলকাতা-ছাড়া হওয়ার কষ্ট এই প্রায় মধ্য চল্লিশেও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় আমায়। দীর্ঘ প্রবাসে তাই থিতু হতে পারা গেল না কিছুতেই। অথচ ইদানীং কেমন সন্দেহ হচ্ছে, সেই তীব্র আকর্ষণেও ভাটার স্রোত লেগেছে। এত দিনে কি তবে এই দীর্ঘ বিচ্ছেদ মানিয়ে নিতে শিখলাম? না কি সব বড় একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে এ শহরে? বড় প্রত্যাশিত? চেনা ফুড কোর্টে চেনা চেনা মুখের সারি, আড্ডার চেনা বিষয় আর সব শেষে ক্লান্তিকর হাসিমুখের সেলফি তুলে ফেসবুকের দেওয়ালে দেওয়া? এখন কি আর কলকাতার পথে কান্না চেপে ঘোরা যায়? এত গাড়ি, এত দূষণ, এত আওয়াজ— কোথায় নির্জনতা খুঁজবে মানুষ? এত উন্নয়নের ভিড়ে নিজস্ব পরিসর কোথায় আর?
শপিং মলগুলোতে ঢুকতে ভয় করে। অজস্র মানুষ অথচ তাদের কথা বলার কায়দা, চলার ভঙ্গি, পোশাকের ধরন প্রায় একই রকম। দেখতে দেখতে মনে হয়, এমন উদগ্র আত্মপ্রচার ছাড়া এই জায়গাগুলোর কি আর কিছু দেওয়ার আছে? কফি শপগুলোতে ঢুকি খানিক নিজস্ব সময় কাটানোর লোভে। আর প্রতি বারই চমকে যাই। এক কাপ ভাল কফি বা চা নিয়ে নিজের মতো করে কিছুটা সময় কাটানোর মূল্য একটু কম করা যেত না কি? এই সব মহার্ঘ পানীয় কত জনের নাগালের মধ্যে? মনটা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে।
শহরের বহিরঙ্গে এত চমক, তবু সে প্রাপ্তমনস্ক হয় না কেন? আজও গলির মুখে জটলায় আলোচনা শুনি, “পাড়াটাকে এরা বৃন্দাবন বানিয়ে রেখেছে!’’— মন্তব্যের অশ্লীলতা কিশোরীবেলার স্মৃতি ফিরিয়ে আনে। ৩০ বছর কেটে গেলেও শহরের বুকে প্রেমিক যুগলের হয়রানির চেহারা আজও বদলায় না। একলা মা হয়ে ছেলে নিয়ে শহরে এসে চাকরির জন্য ঘুরতে ঘুরতে শুনতে হয় দিদি স্থানীয়ার সাবধানবাণী, “আসিস না, এখানে একলা মা ঘর ভাড়া পায় না।’’ অথবা ঈশ্বরপ্রতিম অধ্যাপক বলে ওঠেন, “এসো না, এখানে সকলে তোমার অতীত নিয়ে কাঁটা-ছেঁড়া করবে, টিকতে পারবে না।’’ বাকি সমস্ত অস্তিত্ব অবান্তর হয়ে যায় নিমেষে। সংস্কৃতিবান শহরবাসীর সমস্ত আধুনিকতা ডিজাইনার পোশাক, বাহারের গয়না আর রবীন্দ্রসঙ্গীতে শুরু ও শেষ— এমন সন্দেহ মজবুত হয়।
আধুনিকতার দেখা মেলে না পরিবেশ সচেতনতায়ও। এখনও বাড়ি থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে বড় রাস্তার উপরে দিনের যে কোনও সময়ে পুরুষেরা মূত্রত্যাগ করেন। সেই নরকের পাশ দিয়েই নাক চেপে চলেছি গত ৪০ বছর। এখন কলকাতায় এলে, ছেলেকে নিয়ে ওই রাস্তায় গেলে ওরও নাক চেপে ধরি। রাস্তার ধারে ময়লা ফেলার ডাস্টবিনের পাশে জঞ্জালভর্তি প্লাস্টিক স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে থাকে। শুনতে পাই, নোংরা ফেলার ডাস্টবিন যাতে ছুঁতে না হয়, তার জন্যেই এই ব্যবস্থা!
সর্বাঙ্গের এই মলিনতা ঢাকতে কলকাতা এখন শুধু উৎসবে মেতে থাকে। লম্বা লম্বা সময় ধরে নানা উৎসবে মাতোয়ারা শহর। ভুক্তভোগী বাড়ির লোকের অবস্থা শুনি। রাত ৩টেতেও বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে ভেঁপু বাজিয়ে মানুষ উল্লাসে মাতে। তাতে বয়স্ক মা-সহ বাড়িশুদ্ধ সকলের ঘুম মাথায় ওঠে। দু’পা দূরে মন্ত্রীর পুজো, তার রাজকীয় আয়োজনের কাছে মানুষজনের নিজেদের বাড়ি ঢোকা-বেরনোর দুর্ভোগটুকু বড় অকিঞ্চিৎকর হয়ে পড়ে। ফলে উৎসবের মরসুমে কলকাতা ছেড়ে বাড়ির লোকজন ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দেওয়ার পরিকল্পনা করতে বাধ্য হন।
যৌবনের হিরোদের একে একে ক্ষমতার পায়ে মাথা বন্ধক দিতে দেখি। অথবা তাঁদের মুখ থেকে মুখোশগুলো আলগা হয়ে আসে। তাঁদের প্রেতাত্মারা শহর জুড়ে ঘুরে বেড়ায়। কলকাতাকে অবসন্ন দেখায়। ক্লান্ত চোখের কালি ঢেকে তবু তাকে মুখে রং মেখে হেসে উঠতে দেখি। আমার মুঠি আলগা হয়। ফিরে যাই এক রাশ বিষণ্ণতাকে সঙ্গী করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy