Advertisement
E-Paper

‘মানিয়ে নেওয়ার মন্ত্রটাই ব্যাধি’

পরিবারকে বারবার সমস্যার কথা জানিয়েছেন। প্রতি বারই উপদেশ দেওয়া হয়েছে, আর একটু ধৈর্য ধরতে। পরিস্থিতি প্রতিকূলে গেলে ‘মানিয়ে’ নেওয়ার পরামর্শই জুটেছে কপালে।

সুপ্রিয় তরফদার

শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ০২:০০
হাহাকার: কান্নায় ভেঙে পড়েছেন অন্তরা আচার্যের বাবা-মা। সোমবার। নিজস্ব চিত্র

হাহাকার: কান্নায় ভেঙে পড়েছেন অন্তরা আচার্যের বাবা-মা। সোমবার। নিজস্ব চিত্র

পরিবারকে বারবার সমস্যার কথা জানিয়েছেন। প্রতি বারই উপদেশ দেওয়া হয়েছে, আর একটু ধৈর্য ধরতে। পরিস্থিতি প্রতিকূলে গেলে ‘মানিয়ে’ নেওয়ার পরামর্শই জুটেছে কপালে। কিন্তু ধৈর্য ধরা বা মানিয়ে নেওয়ার যে কী পরিণতি হতে পারে, বারবারই সেটা দেখা গিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে মেয়েদের সঙ্গে যা ঘটে আসছে, আবারও যেন তারই প্রতিফলন দেখা গেল বিরাটির শক্তিগড়ে। অভিযোগ, সন্তান না হওয়ায় নিয়মিত শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা সহ্য করতে হত অন্তরা আচার্যকে (৪০)। গত ২৮ নভেম্বর ঘর থেকে তাঁরই ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়। অন্তরার পরিজনেরাও জানিয়েছেন, মেয়ের সমস্যার কথা অজানা ছিল না তাঁদের।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির হাত ধরে সমাজ অগ্রসর হচ্ছে বলেই মত নানা মহলের। কিন্তু মেয়েদের সম্পর্কে অধিকাংশ জায়গায় যে চিন্তাধারার পরিবর্তন হয়নি, সমাজে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনা তা-ই প্রমাণ করে। সমাজতত্ত্ববিদদের মতে, আপস ও ত্যাগের গুরু মন্ত্র অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবার থেকে পান মেয়েরা।

মনোবিদ ও সমাজতত্ত্ববিদদের বক্তব্য, ভাই বা দাদার সঙ্গে খাবার ভাগ করা দিয়েই আপস করা শুরু। এর পরে পোশাক, শিক্ষা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই তুলনায় কম গুরুত্ব দেওয়া হয় অধিকাংশ মেয়ের মতামতকে। অত্যাচার সহ্য করার মন্ত্র শেখাতে গিয়ে ‘মেয়েদের জেদ ভাল নয়’, ‘মেয়েদের ধৈর্য ও মানিয়ে চলার ক্ষমতা থাকতে হয়’ গোছের মন্ত্র যায় পরিবার থেকেই। তাই পরবর্তী সময়ে শ্বশুরবাড়ি বা অন্যত্র প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকেও তাঁরা বেরিয়ে আসতে পারেন না। বলা ভাল, তাঁদের বেরিয়ে আসতে দেওয়া হয় না। তাঁদের বক্তব্য, সমাজের এই একপেশে মনোভাবের জেরেই যেন সর্বত্র অলিখিত ভাবে সব সময়েই নির্যাতিতার জায়গায় ঠাঁই হচ্ছে মেয়েদের। পণের জন্য নির্যাতন, ভাল রান্না না করার জন্য গঞ্জনা, কন্যাভ্রূণ হত্যা থেকে শুরু করে সন্তান না হওয়ার জন্য কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে তাঁদেরই।

মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের মতে, এটা সামাজিক অশিক্ষা। মেয়েদের মানুষ হিসেবে না দেখে প্রয়োজনের সামগ্রী হিসেবে দেখার কারণেই সমাজে এই ঘটনা ঘটেছে বলে মত তাঁর। তিনি বলেন, ‘‘সার্বিক সচেতনতা তো প্রয়োজনই, পাশাপাশি ছোট্ট বয়সেই পরিবার থেকে মেয়েদের বুঝিয়ে দিতে হবে যে গঞ্জনা-লাঞ্ছনা সহ্য করা কোনও কাজ নয়। আত্মবিশ্বাস জাগাতে হবে। তা হলে মেয়েরা যে কোনও পরিস্থিতির মোকাবিলা নিজেরাই করতে পারবে।’’ মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মেয়েদের দমিয়ে রাখার যে মানসিকতা, সেটা নির্মূল করতে গেলে স্কুল স্তর থেকে সচেতনতা প্রয়োজন। তা হলে হয়তো পরের প্রজন্মকে এই সামাজিক ব্যাধি থেকে দূরে রাখা যাবে।’’

স্কুল স্তরের পাঠ্যক্রম কমিটির চেয়ারম্যান অভীক মজুমদার বলেন, ‘‘ছাত্র-ছাত্রী উভয়েই যে সমান, সেই বার্তা দেওয়ার জন্য পাঠ্যপুস্তকে তার প্রতিফলন রয়েছে। ক্লাসে পড়ুয়াদের সামনে যেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা এই বিষয়টি তুলে ধরেন, সেই বিষয়টি ‘টিচার্স ট্রেনিং প্রোগ্রামে’ রাখা যায়

কি না ভাবা হচ্ছে।’’

তবে কবি শ্রীজাত বলেন, ‘‘বহু তথাকথিত শিক্ষিত সমাজেও এটা হতে দেখেছি যে সন্তান না হলে সব সময়ে মেয়েদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। এ ক্ষেত্রে পুরুষদের কেউ কোনও প্রশ্নই করেন না। মেয়েদের উপরে সব সময়ে সামাজিক চাপ থাকে। এটা দুর্ভাগ্যের। তবে তার জন্য মৃত্যুর পথ বেছে না নিয়ে রুখে দাঁড়ানো প্রয়োজন।’’ তাঁর মতে, ‘‘চেষ্টা করতে হবে অন্তত আমাদের পরের প্রজন্মের মেয়েরা যেন আর এই সমস্যায় না পড়ে।’’

মানিয়ে নেওয়ার রোগ থেকে মুক্তির পাশাপাশি মেয়েদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন সন্তানধারণের প্রক্রিয়া নিয়েও, মনে করাচ্ছেন স্ত্রীরোগ চিকিৎসক মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘অনেক ক্ষেত্রেই দেখি মেয়েরা হতাশ হয়ে আসেন। ধরেই নেন তাঁদের সমস্যা রয়েছে। সন্তানের জন্ম দিতে ওষুধ খেতে হবে তাঁদেরই। পরিবারের লোকেরা যা-ই বলুন, তবু সন্তান না হওয়ার ক্ষেত্রে দায় যে তাঁদের একার নয়, সেটা আগে বুঝে নিতে হবে নিজেদের।’’ এই শিক্ষাটা মেয়েদের মধ্যে আগে ছড়ালে, তবে তো গোটা সমাজ সচেতন হবে।

সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র বলেন, ‘‘মেয়েদের নিচু করা সমাজের একেবারে মজ্জায় ঢুকে গিয়েছে। মানিয়ে নেওয়ার মন্ত্রটাই ব্যাধি। দুঃখের বিষয় হল, বহু ক্ষেত্রে সেই জীবাণু বহন করছেন মেয়েরাই। সন্তান না হওয়া বা যে কোনও বিষয়ে সহজেই মেয়েদের উপরে দায় চাপানো হয়। সেখানেও অন্য মহিলাদের একটা ভূমিকা থাকে। এই রোগ সারাতে গেলে মহিলাদেরই সচেতন হতে হবে। রুখে দাঁড়াতে হবে তাঁদেরই।’’

Torture Human Being Woman
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy