কখনও কলেজের আসন বিক্রি, কখনও কলেজে অনুষ্ঠান করার নামে টাকা তোলা। কখনও আবার কলেজের নাম করে টি-শার্ট বা অন্য উপহার দেওয়ার কথা বলে পড়ুয়াদের থেকে টাকা আদায়। দক্ষিণ কলকাতা আইন কলেজে গণর্ষণের ঘটনার তদন্তে নেমে মূল অভিযুক্ত মনোজিৎ মিশ্রের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ সামনে এসেছে। যার বড় অংশই আর্থিক বলে পুলিশের দাবি। সম্প্রতি পুলিশ এ-ও জেনেছে, কলেজে সংস্কার কাজ চালানো থেকে শুরু করে পাখা-আলো লাগানোর নামে সিন্ডিকেট চালাত মনোজিৎ। দক্ষিণ কলকাতার আরও বেশ কিছু কলেজ থেকেও এ ভাবেই টাকা আত্মসাৎ করত সে। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ এ বার দুর্নীতির মামলা রুজু করে তদন্ত শুরুর কথাও ভাবছে বলে লালবাজার সূত্রের খবর।
আর জি কর হাসপাতালে চিকিৎসক-পড়ুয়াকে খুন-ধর্ষণের ঘটনা সামনে আসার পরে একই ভাবে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে নানা দুর্নীতি সামনে আসে। সেখানে আর্থিক দুর্নীতির ব্যাপারে পুলিশকে সেই সময়ে আলাদা মামলা করে তদন্তে নামতে হয়। আদালতের নির্দেশে তদন্ত শুরু করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই-ও। সেই মতো দক্ষিণ কলকাতা আইন কলেজের আর্থিক দুর্নীতির বিষয়েও আলাদা মামলা করে তদন্ত শুরুর ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। লালবাজার সূত্রের খবর, গণধর্ষণের মামলায় দ্রুত চার্জশিট দেওয়ার পথে পুলিশ। পুলিশি হেফাজতে রেখেই যাতে ধৃতদের বিচার হয় এবং যাতে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়, সে জন্য বিশেষ সরকারি আইনজীবী নিয়োগ করা হতে পারে। সেই সঙ্গেই কথা হয়েছে, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই কলেজ-সহ শিক্ষাক্ষেত্রের যা যা দুর্নীতি সামনে আসছে, সে ব্যাপারে আলাদা দুর্নীতির মামলা রুজু করার ব্যাপারে। আইনজীবী মিলন মুখোপাধ্যায়বলেন, ‘‘পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত মামলা রুজু করেই তদন্তে নামতে পারে। পুরনো কোনও অভিযোগ ধরেও দুর্নীতির মামলা করা যায়। আর জি করে মামলা হয়েছিল পুরনো অভিযোগের ভিত্তিতে।’’
লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্তা বললেন, ‘‘ধৃত মনোজিৎকে কলেজে নিয়োগের ব্যাপারে প্রশ্ন রয়েছে। সে কী ভাবে অন্য আবেদনকারীদের পিছনে ফেলে চুক্তিভিত্তিক কর্মীর চাকরি পেয়ে গেল, সেটা দেখা হচ্ছে। এই নিয়োগের পিছনে কোনও আর্থিক লেনদেন আছে কি না এবং সেই লেনদেনে কারা কারা লাভবান হয়েছেন, সেটা দেখা হচ্ছে। মনোজিতের কলেজে দ্বিতীয় দফায় ভর্তির বিষয়টিও আলাদা করে নজরে রাখা হচ্ছে। তাতেই অবৈধ ভর্তি এবং তার সঙ্গে যুক্ত টাকা লেনদেনের কয়েকটি বিষয় সামনে এসেছে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘কলেজের পরিচালন সমিতির রেজিস্টার থেকে আরও বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গিয়েছে।সব মিলিয়ে আলাদা দুর্নীতির মামলা রুজু করা হবে, না কি মনোজিতের প্রভাবশালী হয়ে ওঠার দিক হিসেবে গোটাটা তুলে ধরা হবে, সে বিষয়ে আইনি পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে।’’
পুলিশ সূত্রে খবর, অন্য নানা আর্থিক লেনদেনের পাশাপাশি নতুন করে সামনে এসেছে দক্ষিণ কলকাতার কলেজগুলিতে নির্মাণ এবং সংস্কারের কাজ করা কয়েকটি সংস্থার নাম। ওই সংস্থাগুলি মিলিয়ে যে নির্মাণ সিন্ডিকেট চলে, তার সঙ্গে মনোজিৎ যুক্ত ছিল বলে প্রমাণ পেয়েছেন তদন্তকারীরা। পুলিশ সূত্রের দাবি, ল কলেজে তো বটেই, দক্ষিণ কলকাতার অন্য কোনও কলেজে সংস্কারের কাজ হলে পরিচালন সমিতি থেকে ওই সিন্ডিকেটের লোকেদেরই কাজ দেওয়া হত। মনোজিৎ এই কাজ আদায় করে আনায় বড় ভূমিকা পালন করত। সেই সূত্রে তার কাছে পৌঁছত টাকার ভাগ। এই আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে অন্য কী কী দুর্নীতি জড়িয়ে রয়েছে, আপাতত তাতে বিশেষ নজর দিচ্ছে পুলিশ।
সূত্রের খবর, ধর্ষণের ঘটনায় ধৃত মনোজিৎ, জাইব আহমেদ এবং প্রমিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘটনার পর থেকে দফায় দফায় কথা হয়েছে, দক্ষিণ কলকাতা ল কলেজের সঙ্গে যুক্ত এমন মোট ২৭ জনকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। তাতেই সামনে এসেছে এই ধরনের নানা দুর্নীতির প্রসঙ্গ। পাশাপাশি ধৃত তিন জনের মোবাইল ফোন থেকেই উদ্ধার হয়েছে একাধিক আপত্তিকর ভিডিয়ো। প্রমিত এবং জাইবের ফোন থেকে মিলেছে গত ২৫ জুনের নির্যাতনের ভিডিয়ো। মনোজিতের ফোন থেকে পাওয়া গিয়েছে কিছু পুরনো ভিডিয়ো। পুলিশ এর মধ্যেই আইন কলেজে কাজ করা অন্য এক নিরাপত্তারক্ষীর মোবাইল ফোনও হেফাজতে নিয়েছে। যদিও তদন্তকারীদের দাবি, প্রমিত এবং জাইব সমস্ত কিছুর দায় মনোজিতের উপরেই চাপিয়েছে এবং মনোজিৎ নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেছে। দফায় দফায় জেরার মুখেও তাকে অনুতাপহীন এবং ভাবলেশহীন অবস্থায় দেখা গিয়েছে। পাশাপাশি, শুক্রবার ভোরে কলেজে নিয়ে গিয়ে ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে তরুণীর বয়ান সম্পূর্ণ ভাবে মিলে গিয়েছে বলেই দাবি পুলিশের।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)