Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
SSKM

বিরল রোগের সফল চিকিৎসা, ফের নিজের পায়ে কিশোরী 

সাত-আট মাস ধরে একের পর এক চিকিৎসক পরিবর্তন করা হলেও পায়ের সমস্যা ঠিক হয়নি।

প্রাপিতা দে।

প্রাপিতা দে।

শান্তনু ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২১ ০৩:০৯
Share: Save:

বাঁ পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। স্পর্শ করলে সেই যন্ত্রণা আরও বেড়ে যেত। শোয়া বা দাঁড়ানো, কার্যত সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফোলা পা নিয়ে তাই সারা দিন চেয়ারে বসেই কাটাতে হত ১৭ বছরের কিশোরীকে। পরিজনদের সঙ্গে বাক্যালাপও বন্ধ করে দিয়েছিল সে। সারা দিন শুধু একটাই প্রশ্ন ছিল, ‘‘আমি কি আর দাঁড়াতে পারব না?’’

সাত-আট মাস ধরে একের পর এক চিকিৎসক পরিবর্তন করা হলেও পায়ের সমস্যা ঠিক হয়নি। সে আশা কার্যত ছেড়েই দিতে বসেছিলেন কিশোরীর পরিজনেরা। সেই সময়ে এসএসকেএম হাসপাতালের ফিজ়িক্যাল মেডিসিন বিভাগে এসে যোগাযোগ করেন তাঁরা। সেখানে ভর্তির পরে চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে জানান, ওই কিশোরী ‘কমপ্লেক্স রিজিয়োনাল পেন সিন্ড্রোম’ রোগে আক্রান্ত। বেশ কিছু দিন চিকিৎসার পরে এখন নিজের পায়ে ভর দিয়েই উঠছে ও দাঁড়াচ্ছে পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথির বাসিন্দা প্রাপিতা দে। তার কথায়, ‘‘দিন-রাত পা ঝুলিয়ে চেয়ারে বসে থাকার কষ্ট ভুলে আবার যে কখনও উঠে দাঁড়াব, তা ভাবিনি।’’

পরিজনেরা জানাচ্ছেন, গত এপ্রিল মাসে লকডাউনের সময়ে জ্বর হয় ওই কিশোরীর। সেই সময়ে দু’টি পায়েই খুব যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল। কিছু দিন পরে ডান পায়ের যন্ত্রণা কমে গেলেও বাঁ পায়ের অবস্থা একই রকম থাকে। সেই সময়েই এক দিন কাঠের দরজায় ঠোকা লেগে বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলে চোট লাগে। এর পর থেকেই যন্ত্রণা আরও বাড়তে থাকে। কিছুতেই তা না কমায় ওই কিশোরীর পরিজনেরা জুন মাসের শেষের দিকে স্থানীয় এক জায়গায় তার এক্স-রে করান। দেখা যায়, বুড়ো আঙুলের কাছে হাড়ে সামান্য চিড় ধরেছে। এর পরে পায়ে প্লাস্টার করা হয় প্রাপিতার।

তার দিদি প্রিয়াঙ্কা সাউয়ের কথায়, ‘‘জুলাইয়ে প্লাস্টার কাটা হলেও পায়ের যন্ত্রণা কমেনি। উল্টে বাঁ পায়ের পাতা ফুলতে শুরু করে। তার পরে তা গোটা পায়ে ছড়াতে থাকে।’’ কিছুতেই সুরাহা না হওয়ায় শেষে সেপ্টেম্বর মাসে কাঁথি থেকে কলকাতায় প্রিয়াঙ্কার বাড়িতে নিয়ে আসা হয় ওই কিশোরীকে।

পরিজনেরা জানান, কলকাতাতেও বেশ কয়েক জন চিকিৎসককে দেখানো হয়। তাঁরাও অবশ্য পায়ের ফোলা ভাব বা যন্ত্রণা কমাতে পারেননি। উল্টে পায়ে স্পর্শ করলেই তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করছিল ওই কিশোরী। ‘‘এমনই অবস্থা হয়ে গেল যে, আমার বোন শুতে বা দাঁড়াতে পারছিল না। সারা দিন পা ঝুলিয়ে চেয়ারে বসে থাকলে কিছুটা আরাম পেত। এমন ভাবেই প্রায় চার মাস কেটে যায়,’’ বলছেন প্রিয়াঙ্কা। তিনি জানান, এর পরে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তাঁরা এসএসকেএম হাসপাতালে এসে প্রাপিতাকে ফিজ়িক্যাল মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করান। ওই বিভাগের প্রধান তথা শিক্ষক-চিকিৎসক রাজেশ প্রামাণিক জানান, ‘কমপ্লেক্স রিজিয়োনাল পেন সিন্ড্রোম’ রোগটির দু’টি ধরন রয়েছে। প্রাপিতা ছিল ‘টাইপ ১’-এ আক্রান্ত, যেটি অত্যন্ত বিরল। এমনই মত চিকিৎসকদের। কারণ হিসেবে রাজেশবাবু বলেন, ‘‘সাধারণত, এটি হাতে হয়। তবে এক লক্ষ মানুষের মধ্যে এক বছরে মাত্র দু’জনের পায়ে এই সমস্যাটি হয়। হাড় ভেঙে যাওয়া, স্ট্রোক, ছোটখাটো দুর্ঘটনা থেকে হতে পারে। আর মেয়েদের ক্ষেত্রেই বেশি হয়।’’

পায়ে অসহ্য যন্ত্রণার কারণ কী? চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, মানুষের শিরদাঁড়ায় ‘ডরসোলাম্বার’-এর আশপাশে ‘সিমপ্যাথিটিক গ্যাংলিয়া’ রয়েছে। যা মানবদেহের যে কোনও অনুভূতিকে বেশ খানিকটা নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু ওই কিশোরীর যন্ত্রণা যখন স্নায়ু মারফত সেখানে পৌঁছচ্ছিল, তখন সেটা অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখানোর ফলে পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছিল প্রাপিতাকে। দীর্ঘ দিন এই রোগের চিকিৎসা না হলে এক সময়ে পা শুকিয়ে বেঁকে যাওয়ার আশঙ্কাও ছিল বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। রাজেশবাবু বলেন, ‘‘অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে ‘সি-আর্ম গাইডেড ইন্টারভেনশন’ দিয়ে ‘লাম্বার সিমপ্যাথিটিক ব্লক’ করে দিতেই মেয়েটির যন্ত্রণা, পা ফোলা অনেক কমে গিয়েছে। আশা করি, কিছু দিনের মধ্যে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে।’’

এখন ঘরের মধ্যেই আস্তে আস্তে হেঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রাপিতা। আর কয়েক মাস বাদেই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। তাই পড়াশোনাও চলছে জোরকদমে। গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে আবার বান্ধবীদের সঙ্গে সাইকেল চালিয়ে ঘোরার অপেক্ষাতেই এখন দিন গুনছে ওই কিশোরী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

SSKM Major surgery
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE