পারিবারিক: পোষ্যকে ফোঁটা। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।
জাতে কী আসে যায়!
তাদের নেই কোনও কুলীন বংশ পরিচয় কিংবা নাম-গোত্র। নেই কোনও স্থায়ী ঠিকানা। রাস্তাই আস্তানা। এখন অবশ্য তাদের দিন বদলাচ্ছে। কিছু মানুষের হাত ধরে এখন তারাও পাচ্ছে ভালবাসার ঠিকানা ও পরিচয়। আদতে এরা পথে ঘাটে অবহেলায় ঘুরে বেড়ানো ‘নেড়ি কুকুর’।
বিদেশি কুকুরের মতো এদের লোমের বাহার নেই। প্রায় ন্যাড়া, তাই নেড়ি নামেই খ্যাত। কিন্তু তাতেও অবশ্য এখন তাদের মধ্যে একটা বড় অংশের পরিচর্যায় কোনও অভাব নেই। যাঁরা তাদের পুষছেন, তাঁরা রীতিমতো সাবান-শ্যাম্পু মাখিয়ে স্থান দিচ্ছেন একই বিছানায় লেপের তলায়।
পশু চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, কয়েক বছর আগেও রাস্তার কুকুরের গায়ের রং দেখে তাদের লালু, ভুলু, কালু নাম দিয়ে একটু আধটু ভালবাসা দেখাতেন কেউ কেউ। কিন্তু পুষতেন দামি বিদেশি কুকুর। শেষ ৫-৬ বছরে মানসিকতা বদলেছে। তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে নেড়িরাই এখন ড্রইংরুমে ঘুরছে, হয়ে উঠছে পরিবারের এক জন। পশু চিকিৎসক কিংবা চিকিৎসা সংস্থার কর্তারা মনে করছেন, কৌলিন্যের কারণে বিদেশি কুকুর এমনিতেই সকলের পছন্দের। কিন্তু নেড়িরা অবহেলার পাত্র হয়ে থেকে যাবে, মানতে পারছেন না অনেকেই।
চিকিৎসক সুবীর ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘নেড়িদের ভালবাসার মানুষ বাড়ছে। বহু তরুণী রোজগারের টাকা অন্য খাতে খরচ না করে দেশি কুকুরের পরিচর্যায় লাগাচ্ছেন।’’ চিকিৎসকদের আরও দাবি, বিদেশি কুকুরের সঙ্গে নেড়ির তেমন পার্থক্য নেই। নেড়ি কুকুরকে ছোট থেকে প্রশিক্ষণ দিলে সে-ও ভাল ‘স্নিফার ডগ’ হতে পারে। কারণ, কুকুরের ‘অর্গান অব জ্যাকবশন’ অত্যন্ত শক্তিশালী। তাই বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় সেনা বাহিনীও স্থানীয় কুকুরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগায়। ঠিক এ ভাবেই, বিধাননগর মেলার ডগ শো-তে দেশি কুকুরেরাও অংশ গ্রহণ করতে পারে।
ভালবাসার হাত ধরে নামের ধরনও বদলেছে নেড়িদের। এখন তারা লালু-ভুলু-কালুর বদলে ফিলিপস্, জ্যাক, ডায়নার মতো বিদেশি নামেও পরিচিত হচ্ছে বলে জানালেন দেশপ্রিয় পার্ক রোডের একটি পশু চিকিৎসা কেন্দ্রের রানা গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘বিদেশিরাও নেড়িদের প্রতি বেশ আগ্রহী।’’ সেই সুবাদে নেড়িরা পাড়ি দিচ্ছে বিদেশেও। রানা জানান, কয়েক বছর আগে ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার স্কট ফার্সেডন উড এক দিন তাঁর সন্তানকে স্কুলে দিতে যাওয়ার সময় প্রায় গাড়ির নিচে চলে যেতে দেখেন একটি নেড়ি কুকুরকে। তিনি সেই কুকুর ছানাকে উদ্ধার করে চিকিৎসা করিয়েছিলেন। এমনকী কলকাতা ছাড়ার সময় লন্ডনেও নিয়ে গিয়েছিলেন প্রিয় ‘সারণি’কে। চিকিৎসকদের মতে, এখন স্কুলস্তর থেকেই পড়ুয়াদের জীবজন্তুদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে শেখানো হচ্ছে।
বিদেশি কুকুর পোষার ঝক্কি ও খরচ বেশি বলেই যে নেড়ির প্রতি ঝোঁক বাড়ছে, এই ধারণা মানতে নারাজ পশু চিকিৎসকেরা। সমস্ত কুকুরকেই জন্মের পরে চারটি বুস্টার ভ্যাকসিন এবং পরের বছর থেকে আজীবন প্রতি বছর তিনটি করে বিভিন্ন ভ্যাকসিন দিতে হয়। নিয়মিত পুষ্টিকর খাবারও দিতে হয়। কসবার একটি পশু চিকিৎসা কেন্দ্রের তরফে সৌমিত্র গুহ বলেন, ‘‘১০০টি কুকুর চিকিৎসা করাতে এলে তার মধ্যে ৪০টাই নেড়ি। প্রয়োজনে কয়েক হাজার টাকা খরচ করে অস্ত্রোপচারও করাচ্ছেন অনেকে।’’ নেড়ির গায়েও গরমে হাল্কা জামা আর শীতে পরিয়ে দেন জ্যাকেট। ঘুরতে গেলে অনেকে পোষ্যকে নিয়ে যেতে প্রথম শ্রেণির কামরা বুক করতেও পিছপা হন না।
তাঁদের কথায়, ‘হোক নেড়ি, তাই বলে কি প্রেম দেব না...?’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy