সেই ডায়েরি। — নিজস্ব চিত্র।
ছোট থেকে ভাইবোন দু’জনে এক সঙ্গেই বড় হয়েছেন। কিন্তু পিঠোপিঠি সেই সম্পর্ক পরিণত বয়সে এসে জটিল হয়ে উঠেছিল বলেই মনে করছেন তদন্তকারীরা।
পুলিশ সূত্রের খবর, রবিনসন স্ট্রিটের বাড়িতে পার্থ দে-র ঘর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বেশ কয়েকটি ডায়েরি ও চিরকুট। তার ভিত্তিতেই গোয়েন্দারা বলছেন, শুধু জটিলতা নয়, পার্থর লেখা ডায়েরির বহু ছত্রে যৌনবিকারের আঁচও পেয়েছেন তাঁরা।
ফ্ল্যাটের মেঝেতে-দেওয়ালে অজস্র চিরকুট মিলেছে। চানঘরের দেওয়ালেও সাঁটানো ছিল বেশ কিছু চিরকুট। তার কোনওটায় লেখা আধ্যাত্মিক বাণী, কোনওটায় কিছু প্রশ্ন। পার্থর ঘরে অন্তত বারোটি ডায়েরি মিলেছে বলে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন। এর মধ্যে দেবযানীরও কয়েকটি ডায়েরি রয়েছে। তদন্তকারীরা বলছেন, ডায়েরির মধ্যে পার্থ তাঁর মা-দিদি সম্পর্কে বেশ কিছু কথা লিখেছেন। তার মধ্যে ঈর্ষাও যেমন রয়েছে, তেমনই নানা অসংলগ্ন কথাও রয়েছে। মনোবিদদের সঙ্গে কথা বলার পর তদন্তকারীদের একাংশের ধারণা, পার্থ ও দেবযানী, দু’জনেই মেধাবী ও উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কোথাও একটা চাপা রেষারেষিও ছিল। সেটাই যৌন বিকৃতির মধ্যে দিয়ে ফুটে বেরিয়েছিল বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে।
কী রকম? পার্থ তাঁর ডায়েরির এক জায়গায় লিখেছেন, ‘‘আমার দিদি বড় হচ্ছে। সে তার জোর খাটাচ্ছিল। মা তাকে ঈর্ষা করছিল।’’ পুলিশের দাবি, দিঘায় বেড়াতে যাওয়ার একটি ঘটনা বিবৃত করে পার্থ তাঁর মা ও দিদির চানঘরের দৃশ্যও লিখেছেন! নিজের দিদি সম্পর্কে পার্থ লিখেছেন, ‘‘আমার বোন আকর্ষণীয়, আরও ক্ষমতাবান হয়ে উঠছে। সে এখন স্বাধীনচেতা।’’
তদন্তকারীদের বক্তব্য, পার্থর লেখায় যৌনবিকারের ছাপ রয়েছে। তিনি এমনও লিখছেন যে, মা তাঁকে যৌনক্ষমতাহীন বলে মনে করেন এবং মাঝে মাঝে পরিচারিকাকে তাঁর দিকে ঠেলে দেন। লালবাজারের এক পুলিশকর্তার মন্তব্য, ‘‘পার্থ যে ভাবে তাঁর মায়ের চরিত্র লিখেছেন, তাতে সেটা কতটা সত্যি তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।’’ তদন্তকারীদের কাছে পার্থ দাবি করেছেন, তিনি কখনও কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্ক তৈরি করেননি।
শুক্রবার পার্থর ঘর থেকে হাত-পা-মাথা ভাঙা কয়েকটি পুতুল মিলেছে। পুতুলগুলির ভাঙা অংশ আলাদা করে কাগজে মুড়ে রাখা ছিল। মিলেছে অদ্ভূতুড়ে কিছু কথা লেখা চিরকুটও। তা থেকে পুলিশের একাংশের অনুমান, পার্থ ঘরে বসে তন্ত্রসাধনা বা ব্ল্যাক ম্যাজিকের চর্চাও করতেন। ঘর থেকে বেশ কিছু আধ্যাত্মিক বইপত্র মিলেছে। সেই সঙ্গে রামায়ণ, মহাভারতের পাশাপাশি অমর চিত্রকথার মতো শিশুপাঠ্য কমিকসের বইও রয়েছে। তদন্তকারীরা বলছেন, পার্থ এমনিতে বিশেষ কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। কিন্তু দিন বারো আগে এক মহিলা ভাড়াটের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। ওই মহিলাকে পার্থ জানান, তিনি একটি আধ্যাত্মিক সিডি তৈরি করছেন। তাতে বিলিতি মন্ত্র থাকবে।
আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝোঁক অবশ্য পার্থর একার ছিল না। তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, দেবযানী দক্ষিণেশ্বরের একটি আশ্রমে নিয়মিত যেতেন। তদন্তকারীরা ওই আশ্রম কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। দেবযানী তাঁর ‘গুরুজি’র জন্য গানের সিডি তৈরি করেছিলেন। ২০১৩ সালের জুনে ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন, ‘‘আজ আমার নতুন জন্ম হল। গুরুজিকে কিছু একটা দিতে পারলাম।’’ কিন্তু ২০১৩-য় যে মানুষ নতুন জন্মের কথা লিখেছেন, তিনি-ই আবার ২০১৪ সালে নানা মানসিক অবসাদের কথা লিখেছেন। একটি চিরকুটে দেবযানী লিখেছেন, ‘‘আমি আর এই জীবন চাইছি না।’’ তার পাশ থেকেই আরও একটি চিরকুট মিলেছে। তাতে অন্য একটি হাতের লেখায় লেখা হয়েছে, ‘‘বাণী, চিয়ার আপ।’’ দেবযানীকে আদর করে ‘বাণী’ বলে ডাকতেন তাঁর বাবা অরবিন্দবাবু। তদন্তকারীদের ধারণা, মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকা মেয়েকে সান্ত্বনা দিতেই চিরকুটে ওই কথা লিখেছিলেন বাবা।
কিন্তু কেন এই অবসাদ? এই রহস্য এখনও কাটেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy