থুত্থুরে বুড়ো ঘোড়ার মতো আদ্যিকালের সব জরাজীর্ণ রেক! সুষ্ঠু পরিষেবা দেওয়ার জন্য যা যা পরিকাঠামো দরকার, তার প্রায় সব কিছু অনেক আগে থেকেই বিগড়েছে। কলকাতা মেট্রোরেলের যাত্রীরা হামেশাই এ সব টের পেয়ে এসেছেন এত দিন। কিন্তু কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে আপৎকালীন পরিস্থিতিতে যাত্রীদের উদ্ধার করার জন্য যে পরিকাঠামো থাকার কথা, সেটাও যে ভিতরে ভিতরে ভেঙেচুরে গিয়েছে, তা প্রকট হয়ে গেল সোমবারের ঘটনায়। সে কথা স্বীকার করে নিয়েছেন রেলকর্তাদের একাংশই।
এ দিন দমদমগামী ট্রেনটি ময়দান ও পার্ক স্ট্রিট স্টেশনের মাঝখানে সুড়ঙ্গে দাঁড়িয়ে যাওয়ার ২০-২৫ মিনিটের মধ্যেই সব ক’টি কামরার আলো-পাখা নিভে যায়। দীর্ঘক্ষণ ওই ভাবে থেকে যাত্রীদের অনেকেই শ্বাসকষ্টে ভুগেছেন। অথচ সময়মতো উদ্ধারকারী দল পৌঁছয়নি। আতঙ্কিত যাত্রীদের আশ্বস্ত করতে মেট্রোর তরফে কোনও ঘোষণা করা হয়নি। যেখানে শুধু আতঙ্কেই প্রাণ যেতে পারত হৃদ্রোগী কোনও যাত্রীর, সেখানে ওই ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত কোনও ব্যাখ্যা না দিয়ে শুধু যান্ত্রিক ত্রুটি বলেই দায় সেরেছেন মেট্রো কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বারবার এই ভাবে পরিষেবা ব্যাহতই বা হচ্ছে কেন, তার সদুত্তর দিতে পারেননি।
ট্রেন থেমে যাওয়ার এক ঘণ্টারও বেশি সময় পরে দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ কয়েক জন মেট্রোকর্মী সুড়ঙ্গের ওই জায়গায় গিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেন। তাঁরা কিন্তু প্রকৃত অর্থে মেট্রোর টাস্ক ফোর্স বা উদ্ধারকারী দলের সদস্য নন। কিছুক্ষণ পরে চালকের কেবিনের দরজা বা আপৎকালীন দরজা খোলা গেলেও জানা যায়, তখনও যাত্রীদের নামার জন্য মই এসে পৌঁছয়নি। মই জোগাড় করার জন্য আরও কিছুক্ষণ সময় লেগে যায়। ওই মই বেয়ে যাত্রীরা এক-এক করে সুড়ঙ্গে নামেন। তার পরে প্রায় একশো মিটার হেঁটে পৌঁছন পার্ক স্ট্রিট স্টেশনে।
পার্ক স্ট্রিট স্টেশন লাগোয়া বড় রাস্তার উপরেই মেট্রো রেলের সদর দফতর। আর ওই ভবনেই কলকাতা মেট্রো রেলের কন্ট্রোল রুম। মেট্রো রেলের পুরো যাত্রাপথ পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা হয় ওই ভবন থেকেই। কিন্তু সদর দফতরের নাকের ডগায় এত বড় ঘটনার পরেও যাত্রীদের উদ্ধার করতে এতটা সময় লেগে গেল কেন, মেট্রো কর্তাদের কাছে তার সদুত্তর মেলেনি।
ঠিক কী ঘটেছিল এ দিন?
মেট্রোরেল সূত্রের খবর, প্রায় কুড়ি বছরের পুরনো ওই রেকটি কারশেড থেকে রওনা করানোর সময়ে তার কোনও ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়েনি। কিন্তু ময়দান স্টেশন ছাড়ার পরেই চালক বোঝেন, মেট্রোর বৈদ্যুতিক সংযোগে গোলযোগ হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ইমার্জেন্সি ব্রেক কষেন। দাঁড়িয়ে পড়ে ট্রেন। তার পরে অনেক কসরত করেও ট্রেনটিকে চালাতে না পেরে চালক কন্ট্রোলে খবর দেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা ট্রেন থেকে বিদ্যুৎ চলে যায়।
নিয়ম অনুযায়ী, মাটির নীচে সুড়ঙ্গ দিয়ে যখন ট্রেন চলে, তখন কোনও রেকের আটকে যাওয়া বা অন্য কোনও দুর্ঘটনার আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে মেট্রোর টাস্ক ফোর্স বা উদ্ধারকারী দলকে পুরোপুরি তৈরি রাখার কথা। কিন্তু সোমবার সেই টাস্ক ফোর্স আদৌ প্রস্তুতই ছিল না। ফলে এ দিক-ও দিক থেকে কর্মী পাঠাতে গিয়ে সময় লেগেছে বলে মেট্রোরেল সূত্রের খবর। এই ধরনের উদ্ধারকারী দল কতটা প্রস্তুত, তা দেখতে মাঝেমধ্যেই মহড়া দেওয়ার কথা। কিন্তু তা মেট্রোয় মানা হয় না বলে অভিযোগ।
মেট্রো কর্তৃপক্ষ অবশ্য এ সব অভিযোগ মানতে চাননি। পুরো ঘটনাটিই তাঁদের মতে, “যান্ত্রিক ত্রুটির বেশি কিছু নয়।” তার পরেও অবশ্য প্রশ্ন উঠেছে, মেট্রোয় বারবার এই ধরনের ঘটনা ঘটে পরিষেবা ব্যাহত হলেও কোনও ক্ষেত্রেই কেন কোনও কর্তাকে দায়ী করে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? এ দিনের ঘটনার পরে রেলকর্তাদের একাংশের বক্তব্য, অনেক হয়েছে। এ বার এই রকম প্রতিটি ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে না দেখে কলকাতা মেট্রোর খোলনলচে পাল্টে ফেলা হোক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy