E-Paper

বাজির আওয়াজে শহর যেন যুদ্ধক্ষেত্র! উৎসবের রাত কাটল আতঙ্কে

কলকাতায় এ বছর কালীপুজোর দিন পাঁচেক আগে থেকেই বাজি ফাটা শুরু হয়ে গিয়েছে বলে নানা মহল থেকে অভিযোগ আসছিল। পুজোর আগের দিন থেকে যা মাত্রাছাড়া চেহারা নিয়েছে।

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৫ ০৮:২৯
চলছে চকলেট বোমা ফাটানো। সোমবার, দক্ষিণ শহরতলিতে।

চলছে চকলেট বোমা ফাটানো। সোমবার, দক্ষিণ শহরতলিতে। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল।

পূর্বাভাস ছিলই। কিন্তু সেই পূর্বাভাস সত্যি হয়ে যে এমন পর্যায়ে পৌঁছবে, তা হয়তো আন্দাজ করেননি অনেকেই। সোমবার, কালীপুজোর দিন সমস্ত নিয়মকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শহর জুড়ে বেআইনি বাজির এমন শব্দ-তাণ্ডব চলল, যা প্রশ্ন তুলে দিল, তবে কি আদালতের রায়, পুলিশের বড় কর্তাদের নির্দেশ— সবই শুধু কাগজে-কলমেই থেকে যাওয়ার জন্য? পুলিশ-প্রশাসনের সমস্ত নির্দেশ অমান্য করে তারস্বরে বাজল মাইক এবং সাউন্ড বক্সও! দিনের শেষে কত বাজি উদ্ধার হয়েছে, কত জন গ্রেফতার হয়েছেন, তা জানিয়ে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করল কলকাতা পুলিশ। কিন্তু তাতে অবশ্য নগরবাসীর ক্ষোভ কিছু মাত্র লাঘব হয়নি। এক ভুক্তভোগীর মন্তব্য, ‘‘উৎসব চলছে, না কি যুদ্ধক্ষেত্রে আছি, বোঝা যায়নি। দিকে দিকে বোমা ফাটছে। কালীপুজোর পরে আরও ক’দিন এই শব্দ-দৈত্যের তাণ্ডব সহ্য করতে হয়, সেটাই দেখার। পুলিশ আর কত বার বাজির লড়াইয়ে ফেল করে, সেটাও দেখার।’’

কলকাতায় এ বছর কালীপুজোর দিন পাঁচেক আগে থেকেই বাজি ফাটা শুরু হয়ে গিয়েছে বলে নানা মহল থেকে অভিযোগ আসছিল। পুজোর আগের দিন থেকে যা মাত্রাছাড়া চেহারা নিয়েছে। দিনের বেলাতেও এমন ভাবে বাজি ফাটতে থাকে যে, বার বার চমকে ওঠেন প্রবীণেরা। একাধিক কুকুর-বেড়াল পাড়াছাড়া। বাড়ির পোষ্যদের নিয়েও নাজেহাল তাঁদের অভিভাবকেরা। কাজে ছুটি নিয়ে অনেককেই বাড়িতে থাকতে হচ্ছে পরিবারের সদস্যের পাশে থাকার জন্য। তাঁদেরই এক জন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী সুলগ্না দত্ত বললেন, ‘‘বাবার হার্টের সমস্যা। এমন ভাবে বাজি ফাটছে যে, কী ঘটে যাবে, ভেবে পাচ্ছি না। বাড়িতে একটি পোষ্যও রয়েছে। কাকে কী ভাবে সামলাব, জানি না। পুলিশে জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি। অন্ধকার ঘুচিয়ে আলো আসার উৎসব এটা। যত দিন যাচ্ছে, আতঙ্কের-ভয়ের উৎসব হয়ে দাঁড়াচ্ছে কালীপুজো।’’ বাজি সংক্রান্ত অভিযোগ জানাতে চালু হওয়া পুলিশের হেল্পলাইন নম্বরে বার বার ফোন করেও এই সময়ে অনেকেই সাড়া পাননি বলে অভিযোগ। অথচ, ওই সময়ের মধ্যেই পরিবেশকর্মীদের সংগঠনের নম্বরে পরিত্রাণ চেয়ে পর পর ফোন এসেছে।

কলকাতার নগরপাল থানার ওসিদের সঙ্গে বৈঠকের পরে গত শনিবারই জানিয়েছিলেন, শহরের আবাসনগুলিতে বিশেষ নজর রাখা হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, সেই নজরদারিতে ফেলই করেছে পুলিশ। রিজেন্ট পার্ক, চেতলা, বালিগঞ্জ, ভবানীপুর, লেক অঞ্চলের আবাসনগুলি থেকে দেদার বাজি ফাটার আওয়াজ পাওয়া গিয়েছে এ দিন। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, পুলিশকে কার্যত দর্শকের ভূমিকায় দেখা গিয়েছে। কোন ছাদে বাজি ফাটছে, তা আন্দাজ করতেই হিমশিম খেয়েছে তারা! উত্তরের টালা চত্বরে এমনই এক আবাসনে মধ্যরাতে দেদার বাজি ফাটানোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাওয়া পুলিশকে আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা দরজাতেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। মানিকতলার এমন একটি আবাসনের বিরুদ্ধে পেরে না ওঠা এক পুলিশকর্মীকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘বাবুরা বলেই খালাস! বহুতলে কী উড়ে উড়ে যাব! আবাসনের লোকজন আমাদের এড়াবে বলে লিফ্‌টে চড়তে দেয় না। এত সিঁড়ি হেঁটে উঠবে কে?’’ একই ভাবে পুলিশকে নাজেহাল হতে দেখা গেল, গলি, সরু রাস্তার ভিতরে বাজির তাণ্ডব বন্ধ করার ক্ষেত্রে।

আদালতের ঠিক করে দেওয়া দু’ঘণ্টার (রাত ৮টা থেকে ১০টা) বদলে দিনভরই বাজি ফাটানো হয়েছে শহর জুড়ে। তবে, সব চেয়ে বেশি অভিযোগ এসেছে বাজির জন্য কুখ্যাত এলাকা বলে পরিচিত কসবা, কাশীপুর, তপসিয়া ও বেলেঘাটার মতো জায়গা থেকে। পাল্লা দিয়েছে হরিদেবপুর, ঠাকুরপুকুর, পর্ণশ্রী, তারাতলা ও কনভেন্ট রোডের মতো কিছু এলাকাও। বেহালা ও মানিকতলার মতো কয়েকটি থানার স্বল্প দূরত্বেই শোনা গিয়েছে শব্দবাজি ও মাইকের তাণ্ডব। অভিযোগ, জোড়াবাগান, শোভাবাজার, বাগবাজার, গিরিশ পার্ক, উল্টোডাঙা বা শিয়ালদহের বেশ কিছু এলাকায় শব্দবাজি এবং সাউন্ড বক্স, এই দুইয়ের উপরেই পুলিশের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এক সময়ে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে বুঝে নিজস্ব দল নিয়ে এলাকায় ঘোরা শুরু করেন কর্তব্যরত ডিসি-রা। অভিযানে নামেন রিজ়ার্ভ ফোর্সের ডিসি-ও। কিন্তু তাতে কাজের কাজ হয়েছে কি? প্রশ্ন রেখেই গিয়েছে কালীপুজোর রাত।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Kali Puja Crackers

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy