এই মঞ্চে ১৭ বছর আগে পুরস্কার নিতে উঠেছিলেন কার্তিক কালিন্দী। কুষ্ঠ আক্রান্ত মা-বাবার সন্তান কার্তিক শিক্ষিত হয়ে আইআইটি খড়্গপুরে উদ্যানপালনে তালিম নেন। দুর্গাপুরের কুষ্ঠ প্রভাবিত নবদিগন্ত কলোনিতে শিক্ষা, ক্ষমতায়নের বড় ভরসা তিনি। এ বার ‘দ্য টেলিগ্রাফ স্কুল পুরস্কার’-এর মঞ্চে অন্যতম পুরস্কারদাতা কার্তিক। ৩০তম বর্ষে দ্য টেলিগ্রাফ এডুকেশন ফাউন্ডেশন আয়োজিত পুরস্কার মঞ্চ নানা ধারাবাহিকতার সাক্ষী। তিন দশকের সঞ্চালক ব্যারি ও’ব্রায়েনের হাত থেকে ব্যাটন নিয়ে সে-কথাই বলছিলেন তাঁর কন্যা রাইসা। স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাকর্মী, অভিভাবকদের এই কুর্নিশ মঞ্চ এখনও সবার আগে ঘা-খাওয়া লড়াকুদের গল্প বলে। এ বছর সেই আখ্যানই ঘা-খাওয়া বাংলা ভাষার উদ্যাপনে উঠে এল।
এবং এই বাঙালিয়ানা মোটেই ডিএনএ-নির্ভর নয়— বোঝালেন ব্যারি ও’ব্রায়েন। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সুরে গলা মিলিয়ে ‘বাঙালি ও’ব্রায়েন’-এর সংযোজন, “নামে আইরিশত্ব থাকলেও ভাষায়, ভালবাসায় আমি বাঙালি।” ডানকুনি পাঠভবনের ছাত্রছাত্রীদের নাচগানের উপস্থাপনাও মাতৃভাষাকে ভালবেসেই সব ভাষাকে ভালবাসার কথা বলেছে। খোপ-কাটা এই সমাজে কোনও একটি ভাষার মতো নানা সময়ে নানা জনকে ব্রাত্য করে রাখা হয়। শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতাও যেমন মানুষকে একঘরে করে। দিল্লির পথকুকুরদের পীড়নের কথা মনে করাল হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত বর্ধমানের রায়নার ক্লাস এইটের সপ্তক রায়। আদরের পুষ্যিটিকে আততায়ীর বিষে হারানোর পরে এখন পশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে জোরালো স্বর সেই কিশোর।
শনিবার সায়েন্স সিটির মঞ্চে বাধা ঠেলে সাহসের মুখের ছবি আঁকা হয়েছে বার বার। আট বছরের তানিশি মুখোপাধ্যায়ের দুষ্টুমি, ছোটাছুটির স্কুলবেলা পাল্টে গিয়েছে শরীরের কোষের বিরল জিনগত রোগে। শুধু আঁচড় পড়েনি মস্তিষ্কে। তাই উঠে বসতে না-পারলেও তানিশি বই পড়ে গোগ্রাসে, বিডিএম মেমোরিয়াল স্কুলে অনলাইন ক্লাস করে। একদা ডাক্তারেরা সন্দিহান হলেও হার মানতে নারাজ ক্লাস থ্রি। তানিশির মা মৌমিতা করগুপ্ত এবং স্কুলের অধ্যক্ষা মধুমিতা সেনগুপ্ত তার হয়ে পুরস্কার নিলেন। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বেসামাল মোটরবাইকের হঠকারিতায় ছিটকে পড়ে শরীরের অজস্র হাড় টুকরো টুকরো হয় কমলা গার্লসের ছোট্ট মেয়ে সৌমী পালের। স্কুলের শিক্ষিকা, বন্ধুদের হাত ধরে খুব ধীরে ধীরে সে মঞ্চে উঠল।
কলেজে পড়ার অদম্য স্বপ্ন মশাটের দিনমজুর ঘরের রাজেশ কর্মকারের। হুইলচেয়ার কেনার সঙ্গতি নেই। হাঁটুতে ভর দিয়ে হেঁটে মঞ্চে উঠলেন। দমদম ক্যান্টনমেন্টের ‘রোলকাকু’ বলে পরিচিত অ্যাপ-মারফত খাবার সরবরাহকারী থেকে সুবিধাবঞ্চিতদের স্কুল গড়ে শিক্ষাব্রতী পথিকৃৎ সাহা হাঁটু গেড়ে বসে তাঁকে পুরস্কার দিলেন। সেন্ট টেরিজ়া স্কুলের প্রিফেক্ট, জটিল অ্যালোপেশিয়ায় মাথার সব চুল হারানো দেবাঙ্গি সামন্তের লড়াইটাও ব্যক্তিগত ও সামাজিক। গ্লকোমায় অন্ধপ্রায় হকার বাবার মেয়ে কমলা গার্লসেরই সমাদৃতা মিত্র মাধ্যমিকে ৯৬% পেয়েছে। তার লড়াইও স্বীকৃতি পেয়েছে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র উত্তর ২৪ পরগনার আটঘরার সাদেক আলির পারিবারিক আয় ৭০০০ টাকা। উদ্যোক্তারা সাদেকেরও পাশে দাঁড়িয়েছেন। উচ্চ মাধ্যমিকে দ্বাদশ স্থানাধিকারী নিবেদিতা স্কুলের বিদিশা বসু টেস্টের আগে বাবাকে হারান। ক্যানসারে আক্রান্ত মা দিল্লির এমসে চিকিৎসাধীন। এমন অপরাজেয়দের পুরস্কার দিতে এসে নজর কাড়লেন মা, মেয়ে সঙ্গীতা ও সহেলি দে। সঙ্গীতা বিয়ের ২৬ বছর পরে মেয়ের সঙ্গে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিএ পাশ করেছেন। মেয়েকে নম্বরে ছাপিয়েও গিয়েছেন কয়েক বার। এখন দু’জনে একসঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে সাংবাদিকতার ক্লাসে ভর্তি। মঞ্চে গ্রামীণ হাওড়ায় পাখি, বাঘরোল, সাপেদের বন্ধু চিত্রক প্রামাণিকের সঙ্গেও কলকাতার আলাপ হল।
হাতে ভর দিয়ে হাঁটা আরামবাগের চাতরা গ্রামের হতদরিদ্র মাস্টারমশাই প্রবীর পালও জলজ্যান্ত বিস্ময়। নিজে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। শিক্ষকতার নেশায় পর পর নিখরচার স্কুল খুলে চলেছেন। দ্য স্কুল দ্যাট কেয়ার্স শিরোপা-জয়ী বেলডাঙার ত্রিশ নম্বর আন্দিরান প্রাইমারি স্কুলের মরমি মনের পরিচয় দিল এই পুরস্কার-মঞ্চ। ৫০ বছর গোসাবার বালিদ্বীপে পড়ে থাকা মেদিনীপুরের সুকুমার পয়রা ‘হল অব ফেম’ স্বীকৃতি পেয়েছেন। বিজয়নগর আদর্শ বিদ্যামন্দিরের রূপকারের জীবনও মানুষ, প্রকৃতিকে ভালবেসে বাঁচার দলিল। আস্থা হারানো দিনে চির ভরসার এক অন্য বাংলার গল্প বলল এ অনুষ্ঠান।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)