ফোন বেজে গেলেও ধরতে পারেননি স্ত্রী। পরে দেড় বছরের ছেলে মোবাইল এগিয়ে দেওয়ায় তরুণী দেখেন, স্বামীর মিসড কল। এর পরে বার বার ফোন করলেও তা বেজে যাচ্ছিল। রাত বাড়তে থাকায় উদ্বিগ্ন হয়ে থানায় যান স্ত্রী। তার কয়েক ঘণ্টা আগেই জিটি রোডে দুর্ঘটনায় এক ট্যাক্সি আরোহীর মৃত্যু ঘটেছে। মৃত ব্যক্তির সঙ্গে থাকা ব্যাগের ছবি দেখাতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তরুণী। হাসপাতালে গিয়ে স্বামীর দেহ শনাক্ত করেন তিনি।
বুধবার রাতে বালির জিটি রোডে বেপরোয়া গতিতে ছুটে আসা সিমেন্ট মিক্সিং ট্রাকের ধাক্কায় দুমড়ে যায় উল্টো দিক থেকে আসা ট্যাক্সি। ধাক্কার তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে, ট্যাক্সি নিয়ে রাস্তার পাশের বাড়ির দেওয়াল ভেঙে ঢুকে যায় দশ চাকার ট্রাকটি। এই ঘটনায় মৃত ট্যাক্সিচালক সিয়ারাম প্রসাদ (৪৯) আদতে গয়ার বাসিন্দা। তবে থাকতেন কলকাতার গোবিন্দ খটিক রোডে। দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ট্যাক্সির আরোহী দিব্যেন্দু দেবনাথেরও (৩৭)। বালির গোস্বামীপাড়ায় তাঁর বাড়ি। ট্যাক্সির পিছনে থাকা দু’টি বাইকও ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে। ওই দু’টি বাইকে চার জন ছিলেন। তাঁদের মধ্যে তিন জনকে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হলেও এক জনকে কলকাতার হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, বুধবার রাত পৌনে ১১টা নাগাদ ঘটনাটি ঘটে বালির দেওয়ান গাজি এলাকায়। বালিখালের দিক থেকে ওই ট্রাকটি বেপরোয়া গতিতে জিটি রোড ধরে ছুটছিল বেলুড়ের দিকে। সেই সময়ে উল্টো দিক থেকে আসছিল হলুদ ট্যাক্সিটি। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, ঘটনাস্থলের কাছেই রাস্তায় লম্বা গর্ত রয়েছে। ট্রাকটির চাকা সেখানে পড়তেই আচমকা রাস্তার ডান দিকে চলে গিয়ে ট্যাক্সিতে মুখোমুখি ধাক্কা মারে সেটি। তাতে রাস্তার পাশের পরিত্যক্ত বাড়ির একাংশ ভেঙে আটকে যায় ট্যাক্সিটি। উপড়ে যায় বাতিস্তম্ভও।
স্থানীয়েরা জানাচ্ছেন, বিকট আওয়াজ শুনে তাঁরা বেরিয়ে দেখেন, ভাঙা বাড়ির ভিতরে ঢুকে যাওয়া ট্যাক্সিতে আটকে চালক-সহ এক যাত্রী। আর রাস্তায় পড়ে দু’টি বাইক। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন চার মোটরবাইক আরোহী। ঘটনাস্থলে যান বালি থানা ও বালি ট্র্যাফিকের আধিকারিক ও বাহিনী। পুলিশ জানাচ্ছে, ট্যাক্সিটি এমন ভাবে দুমড়ে গিয়েছিল যে, ভিতর থেকে যাত্রীকে বার করা যাচ্ছিল না। ভিতরে পিষে গিয়েছিলেন চালক। চার বাইক আরোহীকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানো হয়।
খবর পেয়ে সিইএসসি এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পৌঁছে যান দমকল ও বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের কর্মীরা। বালি কেন্দ্র ক্লাব সমন্বয় সমিতির সদস্যেরাও ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধারকাজে হাত লাগান। দীর্ঘ ক্ষণের চেষ্টায় প্রথমে ট্যাক্সির যাত্রীকে বার করে হাওড়া হাসপাতালে পাঠালে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তখনও ওই যাত্রীর পরিচয় মেলেনি। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান ডিসি (ট্র্যাফিক), এসিপি (উত্তর)-সহ বিশাল পুলিশবাহিনী। পরিস্থিতির খবর নিতে যান বিধায়ক রানা চট্টোপাধ্যায়।
এর পরেও বহু ক্ষণ ট্যাক্সিচালকের দেহ বার করা যাচ্ছিল না। শেষে গ্যাস কাটার দিয়ে দুমড়ে যাওয়া ট্যাক্সির কিছুটা অংশ কেটে তা ক্রেন দিয়ে টেনে বার করার পরে উদ্ধার করা যায় চালকের দেহ। তাঁকেও হাসপাতালে পাঠালে মৃত ঘোষণা করা হয়। ঘটনার জেরে রাত পর্যন্ত জিটি রোডে তীব্র যানজট হয়। ক্রেন দিয়ে ট্রাক ও ট্যাক্সি সরিয়ে নিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। শেষ পর্যন্ত পাশে থেকে উদ্ধারকাজে সাহায্য করা ভাস্করগোপাল চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা ভাবা যাচ্ছে না। বাড়িটিতে লোক থাকলে বড় বিপদ ঘটত।’’ পুলিশ ট্রাকটি আটক করলেও চালক পলাতক।
ট্যাক্সিচালক সিয়ারামের পরিবার থাকে গয়ায়। বাড়িতে তাঁর তিন বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। এ দিনই তাঁর দেহ নিয়ে যাওয়া হয় গয়ায়।
পেশায় কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার দিব্যেন্দু আদতে বরাহনগরের বাসিন্দা। সম্প্রতি বালিতে ফ্ল্যাট কিনেছেন। অফিসের কাজে খড়্গপুর থেকে ফিরছিলেন তিনি। ফেরার পথে রবীন্দ্র সদনে নামেন। রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ স্ত্রী ঈশিতার সঙ্গে ফোনে কথা হলে দিব্যেন্দু জানান, তিনি ট্যাক্সি ধরে ফিরছেন। রাত সাড়ে ১০টায় ফের স্ত্রীকে ফোন করেন দিব্যেন্দু। কিন্তু ঈশিতা কাজে ব্যস্ত থাকায় কথা হয়নি। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, ‘‘ছেলে ফোনটা হাতে দিতেই দেখি, ওর মিসড কল। তার পর থেকে ফোন করলেও ধরছিল না। রাত ১টা নাগাদ থানায় গিয়ে ব্যাগের ছবি দেখে বুঝি, বিপদ ঘটে গিয়েছে।’’
দুর্ঘটনাস্থল থেকে আটশো মিটার দূরে দিব্যেন্দুর ফ্ল্যাট। কিন্তু সেই পথ আর তাঁর যাওয়া হল না। এ দিকে, ছোট্ট ছেলে বার বার মায়ের গলা জড়িয়ে জানতে চাইছে, ‘বাবা কখন আসবে?’ ছেলেকে কোলে নিয়ে তখন চোখের জল চাপার চেষ্টা করে চলছেন ঈশিতা।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)