Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Blood Donor

ভাত জোটাতে মুড়ি বেচছেন ‘রক্তবন্ধু’

শোভাবাজারের শশী শূর লেনের বাসিন্দা, উত্তর কলকাতার ‘রক্তবন্ধু’ হিসেবে পরিচিত তপন দে জানালেন, বদলে যাওয়া জীবনে এখন সংসার চালানোই বড় দায়

অসহায়: স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে তপনবাবু। নিজস্ব চিত্র

অসহায়: স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে তপনবাবু। নিজস্ব চিত্র

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২০ ০৫:৪৪
Share: Save:

করোনা-সংক্রমণ এড়াতে জারি হওয়া লকডাউন বদল এনেছে তাঁর দৃষ্টিহীন জীবনে। ঠিক যেমন বদল এসেছে একশো তেত্রিশ কোটি ভারতবাসীর জীবনে। আগে ঘুম থেকে উঠেই লাঠি হাতে পা মেপে মেপে এগোতেন শিয়ালদহ স্টেশনের দিকে, লজেন্স ফেরি করতে। কিন্তু লকডাউনের কারণে এখন সে সব বন্ধ। হাতের ব্রেল ঘড়িটার সময় ধরে অপেক্ষা করতেন কখন ডাক আসবে, রক্ত দিয়েই ফের ছুটবেন স্টেশনে। কিন্তু এখন তা-ও বন্ধ। কারণ, সামাজিক ছোঁয়াচ বাঁচাতে পাড়ায় পাড়ায় রক্তদান শিবিরই হচ্ছে না।

শোভাবাজারের শশী শূর লেনের বাসিন্দা, উত্তর কলকাতার ‘রক্তবন্ধু’ হিসেবে পরিচিত তপন দে জানালেন, বদলে যাওয়া জীবনে এখন সংসার চালানোই বড় দায়। উত্তরবঙ্গের ট্রেনে বই-লজেন্স বিক্রির পাশাপাশি ডাক পেলেই রক্ত দিতে চলে যেতেন তপনবাবু। তবে এক বার রক্ত দেওয়ার পরের তিন মাসের মধ্যে ডাক এলে না করে দিতেন নিজেই। সেই থেকেই রক্তদান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তেরা তাঁকে উত্তর কলকাতার ‘রক্তবন্ধু’ নাম দেন। শুক্রবার তপনবাবু বলেন, ‘‘মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। টাকা তো দূর, কোনও উপহারও নিইনি। কিন্তু এমন রোগ এল দেশে যে, আর মনে হয় পারব না। কাউকে বাঁচানোর জন্য তো নিজেকেও বাঁচতে হবে!’’ বলতে বলতে দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।

লকডাউনে কেমন আছেন তিনি? কয়েক মিনিট চুপ থেকে তপনবাবু বলেন, ‘‘কয়েক দিন না খেয়ে, আর কয়েক দিন পুলিশের আর পাড়ার লোকের দিয়ে যাওয়া খাবার খেয়ে থেকেছি। এ ভাবে আর কত দিন? পাড়ার এক জনের থেকে টাকা নিয়ে মুড়ি, চানাচুর কিনে বসছি রাস্তায়। সকাল ৭টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত। তার পরে পুলিশ তুলে দেয়। কিন্তু লোকের বাইরে বেরোনোই তো বন্ধ! আজ মাত্র ৪০ টাকার বিক্রি হয়েছে।’’

শশী শূর লেনে যে বাড়িতে ভাড়া থাকেন তপনবাবু, সেখানে আট-দশ ঘর ভাড়াটের বাস। এ দিন দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির সরু গলির দু’পাশে পরপর ঘরে বাস ভাড়াটেদের। প্রতি ঘরে সদস্য-সংখ্যা কমপক্ষে চার-পাঁচ জন। বাড়ির একমাত্র কল থেকে জল নিয়ে ঘরের সামনে বসেই চলে স্নান, কাপড় কাচা। সামাজিক দূরত্বের কোনও সুযোগই নেই।

ছোটবেলায় ক্রিকেট বল লেগে ডান চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তপনবাবুর। ধীরে ধীরে বাঁ চোখের দৃষ্টিশক্তিও হারান। স্ত্রী ইতি দে হালদারও দৃষ্টিহীন। প্রথম পক্ষের স্ত্রীর মৃত্যুর পরে ইতিদেবীর সঙ্গে বিয়ে। ইতিদেবী সল্টলেকের একটি সংস্থায় আগে কাজ করলেও পরে যাতায়াতের সমস্যার কারণে কাজ ছাড়তে বাধ্য হন। তপনবাবুর প্রথম পক্ষের দুই মেয়ে মিশনের একটি স্কুলে থেকে পড়াশোনা করে। দ্বিতীয় পক্ষের দুই মেয়ে পড়াশোনা করে শহরের একটি স্কুলের হস্টেলে থেকে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে স্কুল ছুটি দিয়ে দেওয়ায় সকলেই এখন রয়েছে তপনবাবুর দশ ফুট বাই বারো ফুটের ছোট্ট ঘরে।

ইতিদেবী বলেন, ‘‘আমাদের স্বামী-স্ত্রীর চলে যাচ্ছিল। মেয়েদের স্কুলে খরচ লাগে না। ওরা যাতে ভাল করে পড়াশোনা করতে পারে তাই স্কুলের হস্টেলে রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন পাড়ার এক দাদা। কিন্তু এখন তো স্কুল ছুটি। মেয়েরা বাড়ি চলে এসেছে। রয়েছি সবাই মিলে।’’ পাশে দাঁড়ানো তপনবাবু স্ত্রীর হাত শক্ত করে ধরে গলা নামিয়ে বললেন, ‘‘একসঙ্গে থাকতে তো সমস্যা নেই। কিন্তু খাবারের ব্যবস্থা করাই সমস্যার হয়ে যাচ্ছে, এই যা!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

West Bengal Lockdown Puff Rice Blood Donor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE