সেই ম্যানহোল। নিজস্ব চিত্র
দীর্ঘদিন ধরে পাড়ার মধ্যে ম্যানহোল খুলে নিকাশি নালার জল দিয়েই চলছিল অবৈধ নির্মাণ। অভিযোগ, স্থানীয় কাউন্সিলর বিষয়টি জানলেও সতর্কতামূলক একটি নোটিস দিয়েই দায় সেরেছিলেন। তাতে কাজ হল কি না, সে ব্যাপারে নজর দেননি। প্রাণ দিয়ে যার মাসুল গুনল বছর দু’য়েকের এক শিশু। সোমবার, গার্ডেনরিচে পুরসভার ১৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের সেই খোলা ম্যানহোলে পড়েই মৃত্যু হল তার।
এই ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে। যদিও পুরসভার মেয়র পারিষদ (ইঞ্জিনিয়ারিং) অতীন ঘোষ মঙ্গলবার বলেন, “বারবার সতর্ক করেও ম্যানহোল খুলে বাড়ি তৈরির জল নেওয়ার রেওয়াজ বন্ধ করা যায়নি। এলাকার মানুষ সচেতন না হওয়ায় এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটল।”
পুলিশ জানিয়েছে, মৃত শিশুটির নাম আরশি পরভিন। গার্ডেনরিচে ফতেপুর ভিলেজ রোডের একটি বাড়িতে বাবা-মা ও দুই ভাই-বোনের সঙ্গে থাকত সে। পুলিশ সূত্রের খবর, মহম্মদ আয়ুব ওরফে মংরু নামে এক প্রোমোটার বেআইনি ভাবেই ওই পাড়ার একটি ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে জল নিত। আরশির মৃত্যুর পরে সোমবার রাতেই ওই প্রোমোটারকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ধৃতের বিরুদ্ধে পুরসভার অভিযোগে সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করা ও শিশুটির পরিবারের অভিযোগে অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা রুজু করা হয়েছে। মঙ্গলবার আদালতে মংরু অবশ্য জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়।
কী হয়েছিল সোমবার?
পুলিশ জানায়, ওই দিন বিকেল ৪টে থেকে আরশি নিখোঁজ হয়ে গেলে তার বাবা রাজব আলি গার্ডেনরিচ থানায় অপহরণের অভিযোগ দায়ের করেন। রাত পর্যন্ত শিশুটির হদিস না মেলায় সন্দেহ বাড়ে পরিবারের। পাড়ার এক বাসিন্দা শেখ রাফিক বলেন, “রাত পর্যন্ত আরশির খোঁজ না পেয়ে শেষে আমরাই ওই ম্যানহোলে দেখার কথা ভাবি।” শানোয়ার আলি নামে এক যুবক বলেন, “টর্চ নিয়ে আমি নীচে নেমেছিলাম। ভিতরে দেখি অর্ধেক জলে ডুবে রয়েছে আরশি। পাড়ার ছেলেদের সাহায্যে ওকে তুলে আনি। জ্ঞান ছিল না। শরীর ঠান্ডা।” খবর পেয়ে পুলিশ শিশুটির দেহ এসএসকেএমে নিয়ে যায়।
স্থানীয় সূত্রের খবর, মংরু নিজেই প্রোমোটারি করে। অভিযোগ, আরশিদের বাড়ির পাশেই আধ কাঠা জমি কিনে সেখানে সে অবৈধ ভাবে বাড়ি বানাচ্ছিল। পাড়ার লোকেরা প্রতিবাদ জানানো সত্ত্বেও প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ওই ম্যানহোল খুলে জল নিয়ে নির্মাণের কাজে ব্যবহার করত সে। পুলিশ সূত্রের খবর, আধ কাঠা জমিতে বাড়ি বানানো যায় না। তা ছাড়া, ম্যানহোল খুলতে গেলে পুরসভার অনুমতি লাগে। মংরুর কাছে তা ছিল না। শুধু তা-ই নয়, অভিযোগ, খোলা ম্যানহোলের দিকে নজর রাখারও ব্যবস্থা করেনি সে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও তথা ১৫ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান রঞ্জিত শীল বিষয়টি জেনেও কোনও ব্যবস্থা নেননি। তা অস্বীকার করে মঙ্গলবার রঞ্জিতবাবু বলেন, “বিষয়টি জানতে পেরে আমি ওই জমি পর্যবেক্ষণ করতে যাই। তখনই এক বার ধমকে কাজ বন্ধ করিয়ে দিই। তাতে কাজ না হওয়ায় পুরসভার বিল্ডিং বিভাগে অভিযোগ জানাই। শনিবার পুরসভা থেকে লোক গিয়ে কাজ বন্ধের নোটিস টাঙিয়ে দিয়ে যায়। তা সত্ত্বেও ওই প্রোমোটার কাজ চালিয়ে গিয়েছে।”
এ ব্যাপারে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানানো হয়েছিল কি না জানতে চাইলে বরো চেয়ারম্যান বলেন, “অভিযোগ জানানোর তো সময়ই পেলাম না। অবৈধ নির্মাণের খবর পেলে আগে প্রোমোটারকে কাজ বন্ধ করতে বলা হয়। তাতে কাজ না হওয়ায় পুরসভায় অভিযোগ করি। এর পরে থানায় যেতাম। কিন্তু তার আগেই এই ঘটনা ঘটে যায়। আমি আজই থানায় অভিযোগ জানিয়েছি।”
যদিও পুরসভা সূত্রের খবর, শুধু মংরু নয়, ওই এলাকায় আরও অনেক বাড়ি তৈরিতে ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে জল নেওয়াটাই এখন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নোটিস দিয়ে বা সতর্ক করেও কিছু কাজ হয় না। পুরসভার কর্মী-অফিসারেরাও প্রাণের ভয়ে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস পান না বলে জানিয়েছেন পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারিং দফতরের একাধিক কর্তা। পুলিশও কার্যত সব কিছু দেখেও মুুখ বুঝে থাকেন।
পুরসভা সূত্রের খবর, ১৯৯৫ সালে মোমিনপুর পাম্পিং স্টেশনের কাছে ম্যানহোলে পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয়েছিল এক শিশুর। সে সময়ে অবশ্য প্রবল বর্ষায় জলের তোড়ে তলিয়ে যায় সে। তার চার বছর পরে ১৯৯৯ সালে উল্টোডাঙায় খোলা ম্যানহোলে পড়ে গিয়ে আরও একটি শিশু প্রাণ হারায়। ফের ম্যানহোলে শিশুমৃত্যুর এই ঘটনা নিয়ে তাই ফের পুরসভার নজরদারি নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। এ নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তারা।
এ দিন আরশির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মা সীমা ইয়াসমিন। তাঁর প্রশ্ন, “মংরু-সহ আরও জনা দশেক লোক ঘটনাস্থলে থাকা সত্ত্বেও আর্শি খোলা ম্যানহোলে পড়ে গেল কী করে? আর যদি পড়েও যায়, তা দেখেও ওকে উদ্ধার করার কোনও রকম চেষ্টা বা ব্যবস্থা না করে ম্যানহোল আটকে ওরা চলে গেল কেন?” এ দিন শিশুটির পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যান বরো চেয়ারম্যান। সব জানা সত্ত্বেও ওই নির্মাণকাজ বন্ধ হল না কেন, তা নিয়ে বিক্ষোভ দেখান এলাকাবাসীরা। রঞ্জিতবাবু অবশ্য জানিয়ে দেন, “যা অবৈধ, তা অবৈধই। ওই নির্মাণ ভেঙে দেওয়া হবে।” কিন্তু তা স্রেফ কথার কথা বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা অনেকেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy