Advertisement
২১ জানুয়ারি ২০২৫

হেস্টিংসের চেয়ার আছে, কারিগর কোথায়!

সময়ের ‘দাপটে’ প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের চেয়ারের গদির কাপড় ছিঁড়েছে একটু। কিন্তু চেয়ারের কাঠামো অবিকৃত রয়েছে।

ঐতিহ্য: এখানেই ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম দফতর।

ঐতিহ্য: এখানেই ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম দফতর।

দেবাশিস ঘড়াই
শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৮ ০৩:০২
Share: Save:

রবিবার ছাড়া দরজাটা আর খোলা হয় না। এই দরজা দিয়েই তো ওয়ারেন হেস্টিংস ঢুকতেন!

দরজার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব সুদর্শন প্রসাদ। গত ২৭ বছর তিনি এখানে পিওনের কাজ করছেন। এখানে মানে সেন্ট জন’স চার্চে—শহরের চার্চগুলির মধ্যে প্রাচীনত্বের নিরিখে যা তৃতীয়।

তার পরেই সুদর্শন আঙুল তুলে দেখালেন, ‘‘ওই যে ওয়ারেন হেস্টিংসের চেয়ার। পাশের সিন্দুকগুলোও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। ওখানে নথিপত্র রাখা হত!’’ নথিপত্র তো রাখা হবেই। কারণ ওই চার্চেই তো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম অফিস ছিল, যা আছে এখনও। যে কোম্পানির হাত ধরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উত্থান ও বিস্তার, সেই কোম্পানির চেয়ার, টেবিল, সবই অবিকৃত রাখা রয়েছে ওই চার্চেই!

সময়ের ‘দাপটে’ প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের চেয়ারের গদির কাপড় ছিঁড়েছে একটু। কিন্তু চেয়ারের কাঠামো অবিকৃত রয়েছে। এখনও! কিন্তু তাতে কী! কিছু হলে ওই চেয়ারের কারিগর পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়েই সংশয়ে চার্চ কর্তৃপক্ষ। তাঁদের বক্তব্য, বর্তমানে ওই আমলের চেয়ার-টেবিলের কাজ করার কারিগর খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তা ছাড়া যে কাঠ দিয়ে চেয়ার তৈরি, সেই কাঠ-ও তো এখন সহজে পাওয়া যাবে না। চার্চের ভিতরে একটি কাঠের বিম ছিল, তা বেশ কিছুদিন আগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। সেই বিম সারাই করতেই রীতিমতো ঝক্কি পোহাতে হয়েছিল চার্চ কর্তৃপক্ষকে। অথচ ইতিহাস বলছে, কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটের সেন্ট জন’স চার্চের ওই ঘরে বসেই সারা বিশ্বে ক্রমশ প্রসারণশীল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের সময়কার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল সে সময়। সুদর্শন গড়গড় করে বললেন, কীভাবে চার্চে আগত সকলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ওই ঘরে ঢুঁ মারেন। জানতে চান খুঁটিনাটি।

ওয়ারেন হেস্টিংসের ব্যবহৃত সেই চেয়ার।

প্রসঙ্গত কিছু দিন আগে ‘কলকাতা কি ঔপনিবেশিক শহর?’ শীর্ষক আলোচনাসভায় ইতিহাসবিদ-সমাজবিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘কলকাতা আর ঔপনিবেশিক শহর নেই মোটেই। কলকাতার ঔপনিবেশিক ‘স্পিরিট’ রয়েছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।’ কিন্তু চার্চের ওই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিস ঘরের মধ্যে দাঁড়ালে ঔপনিবেশিক কলকাতার গন্ধ পাওয়া যাবে। চার্চের ফাদার রেভারেন্ড প্রদীপকুমার নন্দা বলেন, ‘‘প্রথম অফিস নিয়ে সংশয় রয়েছে। কিন্তু এটা ঠিক, এই ঘরে বসেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রাইভি কাউন্সিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ওই কাউন্সিলের কারণেই রাস্তার নাম হয় কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট। সে সময়ের সব জিনিসই সংরক্ষণ করার চেষ্টা করেছি আমরা। নথিপত্র-সহ যাবতীয় সামগ্রীর সংরক্ষণে প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু সে আমলের আসবাবপত্রের কাজ করার কারিগর কোথায় আর এখন!’’

এমনিতে সেন্ট জন’স চার্চের চত্বরে যা কিছু আছে, তার সবেতে জড়িয়ে ইতিহাস। ১৭৮৪ সালে ওই চার্চের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন হেস্টিংসই। ১৭৮৭ সালে প্রথম ওই চার্চ সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল। শোভাবাজারের মহারাজা নবকৃষ্ণ চার্চের জন্য জমি দিয়েছিলেন। স্থপতি জেমস অ্যাগের নকশা অনুসারে তৈরি ওই চার্চ। যার পাথর আনা হয়েছিল মালদহ থেকে। চার্চ কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, ‘গ্রেড ওয়ান’ মর্যাদাবিশিষ্ট হেরিটেজ শৈলিকে অক্ষুণ্ণ রেখেই বর্তমানে চার্চের ছাদ মেরামতি চলছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে চার্চের ভিতরের সংস্কারের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

এই চার্চ প্রাঙ্গণেই কলকাতার ‘বিতর্কিত’ প্রতিষ্ঠাতা জোব চার্নকের সৌধ রয়েছে। রয়েছে লেডি ক্যানিং-সহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে জড়িত আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের সৌধ। চার্চের রক্ষণাবেক্ষণে যুক্ত থাকা রবি কোটাক বলেন, ‘‘এক সময় তো চার্চের ভিতরে গাছপালা জন্মে গিয়েছিল। এখন তা পরিষ্কার করা হয়েছে।’’ কিন্তু তাতেও সমস্যা কাটেনি। কারণ, চার্চের শেষ প্রান্তে যেখানে জোব চার্নকের সমাধি রয়েছে, সেখানে নিয়মিত জঞ্জাল ফেলা হয় পাশের আবাসন থেকে। এমনকি চার্চ পরিদর্শনে এক বার যখন বিদেশিরা এসেছিলেন, তখন তাঁদের সামনেই প্লাস্টিক ভর্তি জঞ্জাল পড়ায় চমকে উঠেছিলেন বিদেশিরা, জানাচ্ছেন চার্চ কর্তৃপক্ষ। তাঁরা জানতে চেয়েছিলেন, ইতিহাস জড়িয়ে থাকা কোনও স্থানে কেন এ ভাবে ময়লা ফেলা হয়! কোনও উত্তর দিতে পারেননি চার্চ কর্তৃপক্ষ।

আসলে সেন্ট জন’স চার্চ কর্তৃপক্ষ সে সময় যা বলতে পারেননি, তা হল, কলকাতা হয়তো আর ঔপনিবেশিক নেই! কিন্তু জঞ্জাল রয়ে গিয়েছে! ইতিহাস সম্পর্কে সচেতনতা বোধ না-ই থাকতে পারে, কিন্তু মাথা নত করার মতো অভ্যাস তো রয়েছে! প্রদীপবাবু বলছেন, ‘‘এটা লজ্জার যে, বাইরের লোকের সামনেও আমরা শহরের এই ছবি তুলে ধরি! আমাদের গৌরবের ইতিহাস আছে। সেটাই ভুলে যাই হয়তো!’’

ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

অন্য বিষয়গুলি:

Warren Hastings St. John’s Church East india company
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy