Advertisement
E-Paper

জলবন্দি আমি!

ইস্কুলের পরে জীবনে শেষ কবে ‘রেনি ডে’ এসেছে মনে পড়ে না। একটু কিন্তু-কিন্তু যে লাগছিল না, তা নয়। কিন্তু আনোয়ার শাহ কানেক্টরের অকাল সমুদ্রে ভাসমান বন্ধুর ফোন পেয়ে মনে হল, ঠিকই করেছি।

অনিন্দ্য জানা

শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৫ ২০:০২
Waterlogged Kolkata & a rainy day forced to work from home: few earlier experiences too

কলকাতার জলছবি।

এ তো মেঘ চাইতেই জল!

প্রভূত আনন্দের সঙ্গে প্রথম টেক্সট গেল জিমের ট্রেনারের কাছে। বাইরে বেদম বৃষ্টি। বেরোতে পারছি না। কাল দেখা হবে। দ্রুত সম্মতিসূচক জবাব এল। মনে মনে ভাবলাম, আহা রে! এর মধ‍্যেও জল ঠেঙিয়ে আসতে হয়েছে। কিন্তু কী-ই বা করবে। ওর তো অফিস! আমাকেও তো অফিস যেতে হবে একটু পরে। সে বৃষ্টি-বাদল যতই হোক।

তবে আমার অফিসের তখনও দেরি আছে। জিমে যেতে হবে না ভেবে মনে শিশুর আনন্দ হল। যাক, রাক্ষসের (যে পরিমাণ খাটায়, তাতে অবশ‍্য রাক্ষস-খোক্কসদেরও মায়া হবে) হাত থেকে একদিনের জন‍্য রেহাই মিলেছে। ঘর থেকেই চড়বড় চড়বড় আওয়াজ কানে আসছিল। বারান্দায় গিয়ে দেখলাম, ধুম বৃষ্টি। সল্টলেকের আকাশ স্লেটরঙা মেঘে ঢেকে আছে। ব‍্যালকনির সামনে জ্বলতে থাকা সোডিয়াম ভেপার ল‍্যাম্পের আলোয় স্নান করতে করতে নেমে আসছে বারিধারা। সামনের রাস্তায় গাড়িটা অনাথের মতো ভিজছে।

সে ভিজুক। আমার মনে হল, পড়ে-পাওয়া যে ক’টি ঘণ্টা জীবনে যোগ হল, তাতে চাদরমুড়ি দিয়ে না-ঘুমোলে স্বয়ং বরুণদেব মেঘ বেয়ে নেমে এসে পাপ দিয়ে যাবেন।

সাধারণত খুব ভোরে ঘুম ভাঙে। প্রায় পৌনে ৫টা (প্রায়, কারণ, অ্যালার্ম সেট করা থাকে ভোর ৪.৪০ মিনিটে। ৪৪০ ভোল্টের মতো শক লাগে তো)। আসলে তখন ঘুম ভাঙে না। তখন অ‍্যালার্মটা প্রথম বার ‘স্নুজ’ করি। এ ভাবে আরও বার তিনেক। ততক্ষণে চটকাটা খানিক কেটে যায়। তার পরে হুড়মুড়িয়ে উঠে তৈরি হই। সাড়ে ৫টা থেকে পৌনে ৬টার মধ‍্যে পৌঁছতে হবে।

সোমবার একটা সামাজিক অনুষ্ঠান (ঘটনাচক্রে, সেটা ছিল কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন। যাঁকে আদর করে সকলে ‘জল শোভন’ বলেন। সেই ‘জল’ যে পরদিন সকাল পর্যন্ত গড়াবে, কে জানত) সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ১১টা বেজে গিয়েছিল। তখনও আকাশ ধূসর। টিপটিপে বৃষ্টি পড়ছে। সাহসীদের ছাতা লাগবে না। ঠিকই আছে। মঙ্গলে ঊষা।

ঊষার কিরণ অবশ‍্য দেখা গেল না। সকাল ৮টায় যখন ঘুমটা সত্যি সত‍্যি ভাঙল, দেখলাম বৃষ্টির তেজ আরও বেড়েছে। মিস্‌ড কল দেখে জানলাম, কাজের লোক এসে বেল বাজিয়ে ফিরে গিয়েছে। খবরের কাগজ আসেনি।

আনন্দবাজার ডট কম-এর অ‍্যাপ খুলে দেখলাম প্রথম শিরোনাম: ‘রাতভর বৃষ্টিতে দুর্ভোগ, জলমগ্ন কলকাতার বেশ কিছু এলাকা, কোথাও গোড়ালি তো প্রায় কোথাও হাঁটু অবধি জমেছে জল’। হেডিংয়ে যেটা লেখা নেই, সেটাই ধ্রুব সত‍্য— বিপর্যস্ত জনজীবন। তখনও কি ছাই জানি যে, ওই না-লেখা হেডিংয়ে আমিও লুকিয়ে আছি!

পাম্পের সাহায্যে সল্টলেকের জিডি ব্লকের জমা জল নিকাশের কাজ চলছে, তত্ত্বাবধানে কাউন্সিলর রঞ্জন পোদ্দার।

পাম্পের সাহায্যে সল্টলেকের জিডি ব্লকের জমা জল নিকাশের কাজ চলছে, তত্ত্বাবধানে কাউন্সিলর রঞ্জন পোদ্দার। ছবি: সংগৃহীত।

এর পর তো ফোন ঘোরাতে হয়। কলকাতার বিভিন্ন জায়গার বাসিন্দা বন্ধুবান্ধবের আর্তনাদ ভেসে এল। বৈষ্ণবঘাটা-পাটুলির বাসিন্দা সিনিয়র সহকর্মীর পাঠানো তাঁর বাড়ির নীচের জল থৈ থৈ অবস্থার ছবি এল। টিভি বলল, বাইপাসের কোথাও কোথাও জল জমেছে। বাইপাসের আশপাশের নিচু এলাকা ভাসছে। সল্টলেকের পড়শি ফোনে জানালেন, গোছানো উপনগরী থেকে বাইপাসে ওঠার প্রায় সমস্ত রাস্তা জলমগ্ন। কাতার দিয়ে গাড়ির লাইন। তত ক্ষণে অফিসের হোয়াট্‌সঅ‍্যাপ গ্রুপে পর পর সহকর্মীদের মেসেজ আসছে। অনেকেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাঝরাস্তায় আটকে পড়েছেন। ট্র্যাফিক বিভ্রাট, রেল বিভ্রাট। ওই যে, জনজীবন বিপর্যস্ত!

আমপানের রাতে খুব হেক্কোড় দেখিয়ে তৎকালীন অফিস থেকে বেরিয়ে বন্ধ গাড়িসুদ্ধ সেক্টর ফাইভের রাস্তায় ভেসে যেতে বসেছিলাম। সে গাড়ির মায়া রাস্তায় পরিত‍্যাগ করে অফিস থেকে পাঠানো নিউজ়প্রিন্ট বহনকারী উঁচু ভ‍্যানে উঠে প্রাণপণে জান বাঁচাতে হয়েছিল। পরদিন সকালে সে গাড়ি ব্রেকডাউন ভ‍্যান পাঠিয়ে তুলে আনতে হয়েছিল। বিস্তর হ‍্যাপা! তার পর থেকে গাড়ি জলে আটকে যাওয়াটা আমার কাছে বিভীষিকা। মা (উড়ালপুল)-এর কৃপা থাকলে অফিসে পৌঁছোই সকাল সাড়ে ৯টা থেকে পৌনে ১০টার মধ‍্যে। ভেবে দেখলাম, যা বৃষ্টি হয়েছে, তাতে ওই সময়ে গাড়ি চালিয়ে অফিসে পৌঁছোনো সেরা ফর্মের শোয়েব আখতারকে হেলমেট ছাড়া খেলার মতোই বোকা বোকা অ‍্যাডভেঞ্চার হবে। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ ছাড়া গতি নেই। চিত্তরঞ্জন অ‍্যাভিনিউ জল জমার ক্ষেত্রে যাকে বলে, দাগি আসামি। আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসের সামনে ব‍্যাঙে মূত্রবিসর্জন (এই শব্দটা ‘থ্রি ইডিয়েটস’ থেকে ধার করা) করলেও জল জমে! ফলে গাড়ি আটকানোর সমূহ সম্ভাবনা। আমপান-রাতের স্মৃতি ভীমবেগে ধেয়ে এল। পড়িমরি করে প্রধান সম্পাদককে ফোন করে বাড়ি থেকে কাজ করার অনুমতি চাইলাম। পেয়েও গেলাম।

ইস্কুলের পরে জীবনে শেষ কবে ‘রেনি ডে’ এসেছে মনে পড়ে না। একটু কিন্তু-কিন্তু যে লাগছিল না, তা নয়। কিন্তু আনোয়ার শাহ কানেক্টরের অকাল সমুদ্রে ভাসমান বন্ধুর ফোন পেয়ে মনে হল, ঠিকই করেছি। গলায় নির্ভুল আতঙ্ক। যাদবপুর থানা অভিমুখী রাস্তায় জলের তোড়ে মোচার খোলার মতো ভাসছে তার হ‍্যাচব‍্যাক। ডানপাশের রাস্তা দিয়ে যাওয়া বাসের বিপুলায়তন চাকার ঢেউ ডিভাইডার টপকে এসে ঘাই মারছে প্রায় জানালার কাচে। সারথি প্রমাদ গুনছেন। না উপায় আছে এগোনর। না পিছনোর। লালবাজারে পুলিশ কন্ট্রোলে ফোন করায় তাঁরা বলেছেন, কলকাতা পুলিশের সদর দফতর এলাকাও জলে ভাসছে। তাঁদের বেরোতে হলেও হাফ প‍্যান্ট পরতে হবে!

জলযন্ত্রণার একই চিত্র দেখা গেল উত্তর কলকাতাতেও।

জলযন্ত্রণার একই চিত্র দেখা গেল উত্তর কলকাতাতেও। ছবি: পিটিআই।

কালিকাপুর থেকে সেই বিপুল জলস্রোত ঠেলে এবং প্রতি মুহূর্তে ডুবে যাওয়ার আতঙ্ক কণ্ঠায় ঠেকিয়ে রেখে যাদবপুর থানা পর্যন্ত পৌঁছোতে তার লেগেছে গোটা একটি ঘণ্টা!

কিন্তু সেখান থেকে ডাইনে ঘুরে যোধপুর পার্কের বড় রাস্তা দিব্যি ঠিকঠাক। শুনে মনে হল, দাগির খাতা থেকে নাম কাটা পড়েছে যোধপুরের রাজপথের। যদিও যোধপুর পার্কের ভিতরে ভিতরে বেলা দেড়টাতেও জল-যোগ ছিল।

সাদার্ন অ‍্যাভিনিউ অবশ‍্য তারও আগে সেই সৌভাগ‍্য হারিয়েছে! কলকাতার মেয়র থাকাকালীন সুব্রত মুখোপাধ‍্যায় খানিকটা জেদ করেই সাদার্ন অ‍্যাভিনিউয়ের ‘কৌলিন‍্য’ রক্ষা করতে উদ‍্যোগী হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ওই এলাকার কাউন্সিলর। জেতার পরে গোঁফের ফাঁকে হেসে বলেছিলেন, ‘‘ভোট চাইতে গিয়ে এত লোক সাদার্ন অ‍্যাভিনিউয়ে জল জমার কথা বলেছে যে, এটা না করলে ধোলাই দেবে!’’ কথা রেখেছিলেন সুব্রত। মেয়র হওয়ার পরে তাঁর অগ্রাধিকারের তালিকায় প্রথম ছিল সাদার্ন অ‍্যাভিনিউয়ের নিকাশি ব‍্যবস্থা ঢেলে সাজা।

রাতভোর বৃষ্টিতে গড়িয়ায় বিপর্যস্ত জনজীবন।

রাতভোর বৃষ্টিতে গড়িয়ায় বিপর্যস্ত জনজীবন। ছবি: পিটিআই।

কিন্তু বাকি কলিকাতা আছে কলিকাতাতেই। খোঁজ নিয়ে দেখলাম উত্তরের আমহার্স্ট স্ট্রিট, ঠনঠনিয়া, বিডন স্ট্রিট, গোয়াবাগান, হাতিবাগান, মধ‍্য কলকাতার চিত্তরঞ্জন অ‍্যাভিনিউ যথারীতি ভাসমান। দক্ষিণে এইটবি বাসস্ট্যান্ড এবং যাদবপুর থানার মাঝের রাস্তায় জল, বাঘাযতীন রেল ব্রিজ এবং বাঘাযতীনের কিছু জায়গায় জল। গাঙ্গুলিবাগান, শহিদনগরে জল, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের বেশ কিছু জলমগ্ন। বাইপাসের পাশ বরাবর হাইল‍্যান্ড পার্ক এবং অজয় নগরের মাঝে সার্ভিস রোডেও জল। আরও দক্ষিণে গড়িয়ার কিছু জায়গা, গড়িয়া মোড়, ৬ নম্বর বাসস্ট্যান্ডেও জল জমেছে।

সহকর্মীর পাঠানো গত ২৪ ঘণ্টায় কলকাতা এবং লাগোয়া এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দেখে মনে হল, কোথায় লাগে শুভমন গিল! সর্বত্র সেঞ্চুরি বা তার কাছাকাছি। আমার বাসস্থান সল্টলেকে ৯০ মিলিমিটার! আলিপুরে ৮০ মিলিমিটার, হাওড়ার উলুবেড়িয়ায় ১১০ মিলিমিটার, আমতায় ১০০ মিলিমিটার, দমদমে ১০০ মিলিমিটার, বসিরহাটে ৯০ মিলিমিটার, ব‍্যারাকপুরে ৮০ মিলিমিটার, দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপে ৮০ মিলিমিটার, ক্যানিংয়ে ৭০ মিলিমিটার, হুগলির তারকেশ্বরে ৭০ মিলিমিটার!

তবে কিনা, প্রকৃতি পরম করুণাময়। বৃষ্টি দুপুরের আগে ধরে যাওয়ায় অনেক জায়গার জলই নেমে গিয়েছে। কিন্তু দিনশেষে বাড়ি থেকে এই ডেসপ‍্যাচ পাঠাতে গিয়ে দেখলাম আনন্দবাজার ডট কম বলছে, ‘নিম্নচাপ, সঙ্গে ঘূর্ণাবর্ত! বুধেও ভারী বর্ষণ দক্ষিণবঙ্গে, ছয় জেলায় অতি ভারী বৃষ্টির কমলা সতর্কতা’। কী গেরো!

নিজেকে ‘জব উই মেট’ ছবির করিনা কপূর মনে হল, ‘ইস রাত কো বোরিং বনা দো। অওর এক্সাইটমেন্ট নহি চাহিয়ে!’

kolkata rain very heavy rainfall
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy