Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
বেপাত্তা গোপাল

পুলিশের ঘরেই কি চরের বাস, ধন্দ লালবাজারে

পুলিশ যত বারই আটঘাট বেঁধে হানা দিচ্ছে, তত বারই জাল কেটে পাখি ফুরুৎ! তা হলে কি পুলিশের মধ্যেই লুকিয়ে আছে দুষ্কৃতীর চর? গত শনিবার, কলকাতা পুরভোটের দিনে গিরিশ পার্কে গুলিবিদ্ধ হন সাব-ইন্সপেক্টর জগন্নাথ মণ্ডল। তাতে মূল অভিযুক্ত গোপাল তিওয়ারি ও তার সাঙ্গপাঙ্গের খোঁজে নেমে গোয়েন্দা-কর্তাদের একাংশের মনে এই প্রশ্নটাই বড় হয়ে উঠেছে। সন্দেহের কারণ, ফি বারই তল্লাশি-হানার আগাম খবর অভিযুক্তদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। ‘‘পুলিশেরই কেউ হয়তো গোপাল গ্যাং-কে খবর পাচার করছে। তাই আট বার হানা দিয়েও ওদের টিকি ছোঁয়া গেল না!’— পর্যবেক্ষণ এক গোয়েন্দা-অফিসারের।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৫৮
Share: Save:

পুলিশ যত বারই আটঘাট বেঁধে হানা দিচ্ছে, তত বারই জাল কেটে পাখি ফুরুৎ! তা হলে কি পুলিশের মধ্যেই লুকিয়ে আছে দুষ্কৃতীর চর?

গত শনিবার, কলকাতা পুরভোটের দিনে গিরিশ পার্কে গুলিবিদ্ধ হন সাব-ইন্সপেক্টর জগন্নাথ মণ্ডল। তাতে মূল অভিযুক্ত গোপাল তিওয়ারি ও তার সাঙ্গপাঙ্গের খোঁজে নেমে গোয়েন্দা-কর্তাদের একাংশের মনে এই প্রশ্নটাই বড় হয়ে উঠেছে। সন্দেহের কারণ, ফি বারই তল্লাশি-হানার আগাম খবর অভিযুক্তদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। ‘‘পুলিশেরই কেউ হয়তো গোপাল গ্যাং-কে খবর পাচার করছে। তাই আট বার হানা দিয়েও ওদের টিকি ছোঁয়া গেল না!’— পর্যবেক্ষণ এক গোয়েন্দা-অফিসারের।

লালবাজার সূত্রে জানা যাচ্ছে, গোপালের মোবাইল ফোন ‘ট্র্যাক’ করে বৃহস্পতিবার রাতে গোয়েন্দা-দল বীরভূমের রামপুরহাটে হানা দেয়। কিন্তু গোপালদের কাউকে পাওয়া যায়নি। আবার মঙ্গলবার রাতে খবর এসেছিল, স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গোপাল পাথুরিয়াঘাটার বাড়িতে আসবে। সেই মতো টিম গড়ে গোয়েন্দারা তক্কে তক্কে ছিলেন। সে বারও গোপাল দেখা দেয়নি! তার শাগরেদ রাজু, বাবলি, মনোজ সিংহ বা রামুয়াদের খোঁজও মেলেনি। গোয়েন্দাদের একাংশের সন্দেহ, গিরিশ পার্কে অভিযুক্ত এই দুষ্কৃতীরা গোপালের সঙ্গেই ছায়ার মতো সেঁটে রয়েছে।

আর পুলিশের গতিবিধি আগাম জানতে পেরে দলবল নিয়ে গোপাল নিত্য ডেরা বদলাচ্ছে বলে লালাবাজারের একাংশের সন্দেহ। এই মহলের অভিযোগ, কলকাতা পুলিশের সদরে কর্মরত বেশ কিছু অফিসারের সঙ্গে গোপালের যথেষ্ট ‘সুসম্পর্ক’ রয়েছে, যার নমুনা শনিবারই তাঁরা চাক্ষুষ করেছেন।

কী রকম?

সূত্রের খবর: গুলিচালনায় গোপালের নাম উঠে আসা ইস্তক গুন্ডাদমন শাখার এক ইন্সপেক্টর দাবি করতে থাকেন, এতে গোপাল জড়িত নয়। ‘‘ওঁর সঙ্গে গোপালের খাতিরদারির কথা আমরা অবশ্য আগেই জানতাম। তাই আমল দেওয়া হয়নি।’’— বলছেন এক গোয়েন্দা-কর্তা। এ-ও জানা গিয়েছে, ধরপাকড় শুরু হতেই লালবাজারের দুই অফিসার গোপালকে ফোন করে দীর্ঘ ক্ষণ কথা বলেছিলেন।

এমতাবস্থায় দুঁদে গোয়েন্দা-অফিসারদের অনেকেই সন্দিহান। তাঁরা বুক ঠুকে বলতে পারছেন না যে, খবর পাচার হচ্ছে না। সরকারি ভাবে যদিও লালবাজার ব্যাপারটাকে সামনে আনতে নারাজ। এক গোয়েন্দা-কর্তার কথায়, ‘‘স্বাভাবিক। পুলিশেরই কেউ গোপালকে খবর দিচ্ছে— এটা সামনে এলে আমাদের মুখ পুড়বে।’’ কিন্তু গোপাল-ঘনিষ্ঠ হিসেবে কোনও অফিসারের সম্যক ‘পরিচিতি’ থাকা সত্ত্বেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন?

লালবাজারের অন্দরের ইঙ্গিত, গোয়েন্দা বিভাগের গুন্ডাদমন শাখার সংশ্লিষ্ট অফিসারটি শীর্ষ কর্তাদের নেকনজরে আছেন। তাই তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নিতে গোয়েন্দা-কর্তারা কিছুটা দ্বিধায়।

তবে কলকাতা পুলিশের নীচু ও মাঝারিতলার অফিসারদের একাংশের বক্তব্য, গোপালপর্বের দায় লালবাজারের মাথারাও এড়াতে পারেন না। কারণ, গুন্ডাদমন শাখার একাংশ শনিবারই চেয়েছিল গোপালকে হাজতে পুরতে। গোপাল সে সময় দলবল সমেত শাসকদলের এক নেতার বাড়িতে হাজির ছিল। দোটানায় পড়ে কর্তারা সে দিন অনুমতি দেননি।’’— আক্ষেপ এক গোয়েন্দা-অফিসারের।

এবং তারই মওকায় গোপাল সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে শহর ছেড়ে পালিয়েছে বলে অভিযোগ। অফিসারদের কেউ কেউ কর্তাদের ‘দোটানা’র সম্ভাব্য ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। ওঁরা বলছেন, গুলিচালনার পরেই মধ্য কলকাতার তৃণমূল নেতা সঞ্জয় বক্সীর দলীয় অফিস থেকে অশোক শাহ ও দীপক সিংহ নামে দুই তৃণমূলকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। প্রসঙ্গত, গোপালের সঙ্গে সঞ্জয়বাবুর ‘মাখামাখি’ নিয়ে বিরোধীরা ইতিমধ্যে সরব। সঞ্জয়বাবু তা অস্বীকার করলেও গোয়েন্দা মহলের ব্যাখ্যা: গোপাল ধরা পড়লে তার ‘মদতদাতাদের’ বিরুদ্ধে অভিযোগ নিঃসন্দেহে জোরালো হবে। স্বভাবতই শাসকদল অস্বস্তিতে পড়বে। তেমন পরিস্থিতি এড়াতেই গোপালকে গ্রেফতার করতে লালবাজারের মাথারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন কিনা, পুলিশের অন্দরে সেই প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে।

বস্তুত গিরিশ পার্ক-কাণ্ড সম্পর্কে বুধবার লালবাজার যে রিপোর্ট রাজ্য নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়েছে, সেখানে ধৃতদের নাম উল্লেখ করা হলেও রাজনৈতিক পরিচয় জানানো হয়নি। এর পিছনে ‘শাসকদলের মুখ বাঁচানো’র উদ্দেশ্য দেখছেন আম পুলিশকর্মীদের একাংশ। লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তার অবশ্য ব্যাখ্যা, ‘‘তদন্ত শেষ হয়নি বলেই ধৃতদের রাজনৈতিক পরিচয় লেখা হয়নি।’’ পাশাপাশি ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী তথা হামলায় আহত নির্দল প্রার্থী বিক্রম সিংহের বয়ান এখনও কেন নেওয়া হল না, সে প্রশ্ন উঠেছে। যার জবাবে তদন্তকারী-সূত্রের মন্তব্য, ‘‘বিক্রমের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে। প্রয়োজনে বয়ান নেওয়া হবে।’’ শুক্রবার গোপালের পাথুরিয়াঘাটার বাড়িতে গোয়েন্দারা এক দফা তল্লাশি চালান। তাতে গোপালের ব্যাঙ্ক আকাউন্ট ও সম্পত্তি সংক্রান্ত কিছু নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তার স্ত্রী ও ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে বলে পুলিশ-সূত্রের খবর।

এ দিকে গিরিশ পার্ক-কাণ্ডে ধৃত দুই সক্রিয় তৃণমূলকর্মী অশোক শাহ ও দীপক সিংহ-সহ ছ’জনকে শুক্রবার ব্যাঙ্কশাল আদালতে তোলার পরে সরকারি কৌঁসুলি দাবি করেন, অভিযুক্তেরা বিহার-উত্তরপ্রদেশে গিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে, তাদের হদিস পাওয়ার স্বার্থেই ধৃতদের পুলিশি হেফাজতে রাখা জরুরি। জামিনের আর্জি খারিজ করে ধৃতদের ২ মে পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE