গত বছর আরজি কর-কাণ্ড ঘটে যাওয়ার পরে শাসকদলের অন্দরের আলোচনায় উঠে এসেছিল ছাত্র সংসদ ভোটের প্রসঙ্গ। কলেজে-কলেজে এক শ্রেণির নেতার ‘দাদাগিরি’, ‘তোলাবাজি’, ছাত্রনেতার পরিচয় ভাঙিয়ে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ কায়েম করা এবং সর্বোপরি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন নেতৃত্ব উঠে না-আসার মৌলিক রাজনৈতিক প্রসঙ্গ জোরালো ভাবে আলোচিত হয়েছিল তৃণমূলের অন্দরে।
সেই পর্বেই গত বছর ২৮ অগস্ট শাসকদলের ছাত্র সংগঠন তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)-এর প্রতিষ্ঠা দিবসের মঞ্চ থেকে তৃণমূলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, পুজোর পরেই ছাত্র সংসদের ভোট হবে। বছর ঘুরে আরও একটা পুজো আসতে চলেছে। কিন্তু মমতার সেই ঘোষণা বাস্তবায়িত হয়নি। কসবার আইন কলেজে ছাত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনায় টিএমসিপি-র সঙ্গে অভিযুক্তদের নাম জড়ানোয় সেই পুরনো প্রশ্নই নতুন করে উঠতে শুরু করেছে— ছাত্র সংসদ ভোট কবে হবে?
‘সিমেস্টার’ ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে নির্বাচনের প্রক্রিয়াগত ‘জটিলতা’র কথা প্রকাশ্যে বললেও টিএমসিপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বও একান্ত আলোচনায় মানছেন, নির্বাচন না-হওয়ার ফলে বহু খেসারত দিতে হচ্ছে সংগঠনকে। যার অভিঘাত সুদূরপ্রসারী।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার আওতাধীন কলেজগুলিতে ২০১৭ সালে শেষ বার ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছিল। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন হয়েছিল ২০১৯ সালে। যাদবপুরে ছাত্রভোট হয়েছে ২০২০ সালে। তার পর থেকে কোনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। শুক্রবার কসবার ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরে টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য নতুন সিমেস্টার ব্যবস্থায় নির্বাচন করার জটিলতা, তার আগের কোভিড পরিস্থিতিতে শিক্ষাব্যবস্থা ধাক্কা খাওয়ার প্রসঙ্গ তুলে জানিয়েছিলেন, কী ভাবে সব দিক রক্ষা করে ছাত্র সংসদ ভোট করা যায় সে বিষয়ে ‘গবেষণা’ চলছে! সেই ‘গবেষণা’ আর কত দিন চলবে? একটা আরজি কর বা একটা কসবার মতো ঘটনা ঘটলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ উঠবে তার পরে আবার তা ধামাচাপা পড়ে যাবে? শনিবার এই প্রশ্নের জবাবে তৃণাঙ্কুর বলেন, ‘‘আমি রাজনৈতিক স্তরের কর্মী। প্রশাসনের অংশ নই। নির্বাচন হবে কি হবে না, সেটা সম্পূর্ণ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত।’’ তাঁর এ-ও দাবি যে, কী প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্বশাসন বজায় রেখে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করা যায়, সে বিষয়ে তিনি সরকারকে ইতিমধ্যেই প্রস্তাব দিয়েছেন।
তৃণাঙ্কুরের ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, নির্বাচন না-হওয়ার ফলে টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতিকেই সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়তে হচ্ছে। তাঁদের ব্যাখ্যা, তৃণাঙ্কুর ২০১৮ সালে সংগঠনের সভাপতি হয়েছেন। কিন্তু কলেজে-কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলিতে যাঁরা ‘ছাত্রনেতা’, তাঁরা তার আগে থেকে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে মৌরসিপাট্টা কায়েম করে রেখেছেন। ফলে সেই নেতারা রাজ্য সভাপতির নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তৃণাঙ্কুরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, ‘‘ভোট হলে নতুনেরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় চালাবেন। তাঁদের পরিচালনা করা সহজ। কিন্তু, পাকামাথাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। যাচ্ছেও না।’’ বস্তুত, সেখানে এলাকার রাজনীতির সমীকরণের কথাও উল্লেখ করছেন তাঁরা।
যদিও বিরোধীরা শাসকদলের এই সমস্ত যুক্তিকেই ‘ছেঁদো’ বলছে। তাদের বক্তব্য, ফন্দিফিকির করেই ভোট আটকে রাখা হয়েছে। তার কারণ, ভোট হলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কাঁচা টাকার যে ‘চক্র’ তৈরি হয়েছে, তা ভেঙে যাবে। শাসকদল তা ভাঙতে দিতে চায় না। প্রদেশ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি তথা প্রাক্তন সাংসদ অধীর চৌধুরীর কথায়, ‘‘বছরের পর বছর কলেজগুলোয় নির্বাচন না-করিয়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের হাতে ইউনিয়নের দখল দিয়ে রেখেছে। তৃণমূল এই সব ঘটনাকে বাংলার নব বাস্তবতায় (নিও নর্মাল) পর্যবসিত করেছে। ভর্তি হতে গেলে পয়সা দিতে হবে। সঙ্গে আরও কিছু দিতে হবে। এটাই এখন বাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।’’ সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক দেবাঞ্জন দে-র বক্তব্য, ‘‘ওরা ভোট আটকে রেখেছে নিজেদের স্বার্থ কায়েম করার জন্য। আর তা করতে গিয়েই একটা করে আরজি কর, কসবা আইন কলেজের মতো ঘটনা ঘটছে। কারণ, কাঁচা টাকার কারবারের সঙ্গে ওরা ক্যাম্পাসগুলোকে দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চল করে রাখতে চাইছে।’’ আরএসএস-এর ছাত্র শাখা অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের দক্ষিণবঙ্গের রাজ্য সম্পাদক অনিরুদ্ধ সরকারের বক্তব্য, ‘‘তৃণমূলকে বলতে হবে, কেন মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ছাত্র সংসদের ভোট হচ্ছে না? একটার পর একটা ঘোষণা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে ভোট হচ্ছে না। এর অর্থ কী? মুখ্যমন্ত্রী কি প্রক্রিয়া না-জেনেই ভোটের কথা ঘোষণা করেছিলেন?’’
উল্লেখ্য, মমতা গত বছর যে মঞ্চ থেকে বলেছিলেন, পুজোর পরেই হবে ছাত্র সংসদ ভোট, সেই মঞ্চ থেকেই আরও এক কদম এগিয়ে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘আমি অনুরোধ করব, আগামিদিনে ছাত্র সংসদ নির্বাচন যখন হবে তখন ৫৫ শতাংশ আসনে যাতে মেয়েরা, আমাদের বোনেরা লড়াই করার সুযোগ পান, সেই বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে। ৫০ শতাংশ নয়, ৫৫ শতাংশ। হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে, ইন্ডিয়া থিঙ্কস টু’মরো। আমরা মেয়েদের, বোনেদের, দিদিদের যাতে এই সুযোগ দিতে পারি, তার ব্যবস্থা করতে হবে।’’ সে পরামর্শেরও বছর ঘুরতে চলল। ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ৫৫ শতাংশ ছাত্রীদের লড়া সুনিশ্চিত করা তো দূরস্থান, নির্বাচনের ভূমিকাটুকুও করা হয়নি।
তবে নির্বাচন না-হওয়ার (বা না-করার) বিষয়ে তৃণমূলের প্রথম সারির অনেক নেতা পৃথক আশঙ্কার কথাও বলছেন। তাঁদের বক্তব্য, রাজ্যের সিংহভাগ কলেজে বিরোধীদের তেমন কোনও সংগঠন নেই। ফলে ভোট হলে তৃণমূলই জিতবে। কিন্তু কলেজে-কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের মধ্যে রয়েছে একাধিক গোষ্ঠী। সেই কোন্দল নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘কলেজের ‘মধু’ সবাই খেতে চায়। যার সঙ্গে বহু জায়গায় জুড়ে রয়েছে এলাকার রাজনীতির গোষ্ঠীবাজিও। নির্বাচন হলে তা খুব একটা নিরামিষ হবে না। ফলে দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব বা সরকারের উপরমহল হয়তো সে কারণেই চটজলদি ভোট করতে পারছে না।’’
প্রসঙ্গত, রাজ্যের প্রতিটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্র সংসদের ‘ক্যালেন্ডার কর্মসূচি’ (নবীনবরণ, ছাত্র উৎসব, সরস্বতীপুজো) জারি রয়েছে। সেই সূত্রেই প্রশ্ন উঠছে, এই কর্মসূচিগুলিতে অর্থ খরচ হলেও তা নির্বাচিত কোনও ছাত্র সংসদের মাধ্যমে হয় না। সেখানেই অর্থ নয়ছয়ের মূল উৎস বলে অভিযোগ করছেন বিরোধীরা। কয়েক মাস আগেই নানাবিধ গন্ডগোল সামলাতে মধ্য কলকাতার একটি কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি পদে মন্ত্রী শশী পাঁজাকে বসাতে বাধ্য হয়েছিল বিকাশ ভবন। দক্ষিণ কলকাতার একটি কলেজে যেমন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে। কিন্তু তাতেও ‘ক্ষমতার ভবি’ ভুলছে না। তৃণমূলের প্রথম সারির অনেক নেতা মেনে নিচ্ছেন, সর্বত্র পরিচালন সমিতিও পুরনো ছাত্রনেতাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ফলে নানাবিধ ঘটনা ঘটে চলেছে। যা দল এবং সরকারকে বারংবার অস্বস্তির মধ্যে ফেলছে।
কসবার ঘটনার পরে পুরনো প্রশ্ন মতুন করে উঠলেও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নির্বাচন হবে কি না, তা শাসক শিবিরের কেউই জোর দিয়ে বলতে পারছেন না। কারণ, তাঁরা জানেন, যে কোনও গবেষণার মতোই তৃণাঙ্কুর-কথিত ‘গবেষণা’ শেষ হতেও সময় লাগবে। সম্ভবত অন্যান্য গবেষণার চেয়েও বেশিই সময় লাগবে। তত দিনে আরও কিছু আরজি কর বা কসবার মতো ঘটনা তৈরি হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হবে না? শাসক শিবির মৌনীই থাকছে।