বক্তা: ‘কলকাতা লিটারারি মিটে’ ইয়ান মার্টেল। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
‘পায়ে পড়ি বাঘমামা, ক’রো না কো রাগ মামা’— গানটা শোনা হয়নি ‘লাইফ অব পাই’-এর লেখকের। একান্ত আলাপচারিতায় সত্যজিতের গুপি-বাঘা কাহিনি হীরক রাজার দেশের বাঘের কথা তবু বেশ গম্ভীর মুখেই শুনলেন ইয়ান মার্টেল।
দু’দশক আগে লেখা ‘বাংলার বাঘ’-এর সঙ্গে উত্তাল মহাসাগরে এক কিশোরের নৌযাত্রার কাহিনি এখন গোটা দুনিয়া জানে! কোটি কপি বিক্রি হওয়া বই থেকে অস্কারজয়ী সিনেমার দৌড়ও কম নয়। লেখক ইয়ান মার্টেল তবু এই প্রথম বাংলার বাঘের দেশে এলেন।
বৃহস্পতিবার, সন্ধ্যা। স্থান, গঙ্গাবক্ষ। ‘কলকাতা লিটারারি মিট’-এর আসরে নৌবিহারে লাইফ অব পাই-এর ইতিকথা শুনতে উৎসাহের অন্ত ছিল না। প্রমোদতরীতে ভিড়ের আশঙ্কাও ছিল উদ্যোক্তাদের। ইয়ানের উপন্যাসের মতো আলোচনা-আসরেও জাহাজডুবি ঘটলে বাড়াবাড়ি রকমের বাস্তবধর্মী হত! কলকাতার নিস্তরঙ্গ গঙ্গার বুকে ফুরফুরে আমেজ বরং উপন্যাসে অন্তর্লীন সত্যের খোঁজে ডুব দিল। অবসরপ্রাপ্ত এক স্কুলশিক্ষিকা ইয়ানের কাছে জানতে চাইছিলেন, এ দেশে স্কুলপাঠ্য বইয়ে লাইফ অব পাই-এর একটি অংশে বাঘের চরিত্রটা কী ভাবে পড়া উচিত। বাঘটা সত্য়ি না প্রতীক— সেই বহুচর্চিত জল্পনায় ঢুকতে চাননি ইয়ান। তবে পাঠকদের চোখে ‘লাইফ অব পাই-এর দু’-একটি ব্যাখ্যার নমুনা পেশ করলেন। জাহাজডুবির পরে সব হারিয়ে ডিঙিনৌকোয় হিংস্র বাঘের সঙ্গে দিন-রাত সহাবস্থান, অবিশ্বাস-আতঙ্ক-বন্ধুতার রোমাঞ্চকর সফর, শেষে একেবারেই অ-নাটুকে সম্ভাষণহীন বিচ্ছেদ— এটা কি আসলে বিবাহিত জীবনের রূপক? ইয়ান হাসছিলেন, ‘‘আমি ও সব ভেবে লিখিনি। কিন্তু পাঠকের কথাটা উড়িয়েই বা দিই কী করে!’’ তাঁর কথায়, ‘‘এই বইটা একান্তই গণতান্ত্রিক। এখনও লোকে এসে নিজের মতো ভাবনার গিঁট পাকায়। আরও কত জনের মনে বইটা যেন লেখা হয়েই চলেছে।’’ তাঁর আর এক তৃপ্তির জায়গা, ‘‘লাইফ অব পাই-এর প্লটে দুর্যোগ, খুনোখুনি, মৃত্যু ভরপুর! কিন্তু ছোটরাও বইটাকে কী দারুণ ভালবেসেছে।’’ জন্তু-জানোয়ারেরা গল্পের চরিত্র হলে ছোট বা বড়— সকলের কাছেই সহজে পৌঁছনো যায়, বিশ্বাস করেন ইয়ান।
চিনা বংশোদ্ভূত পরিচালক অ্যাং লি এ কাহিনির চলচ্চিত্রায়ণের ভার নেওয়ার পরেও তাঁর গল্পের কী হবে, তেমন ভাবেননি লেখক। বই সিনেমা হলে লেখকের সব দিকেই সুবিধে, মনে করেন ইয়ান। ‘‘সাধারণত বইয়ের বিক্রি বাড়ে। ছবি ভাল হলে লোকে লেখককে মাথায় করে রাখবে, আর খারাপ হলে দুষবে পরিচালককেই।’’
বাঙালিরা যে সিনেমাকে বই বলেন, সে কথাটা আলাদা করে বলা হল না ইয়ানকে। একান্তে দু’চার কথায় বরং কলকাতা-প্রসঙ্গই ভেসে এল। শুক্রবার, এ শহর ছেড়ে যাওয়ার আগে তাঁর হোটেলের পাশেই আলিপুর চিড়িয়াখানায় বাঘদর্শন সেরে নিয়েছেন। হোক খাঁচায় বন্দি, তবু তাঁর বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র তো বটেই! বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ইয়ান কিন্তু একটা বিষয়ে কলকাতাকে মুক্তকণ্ঠে শংসাপত্র দিয়েছেন। ‘‘এই শহরের রাস্তার কুকুরগুলো চমৎকার সুখী-সুখী! নিশ্চয়ই কেউ ওদের আদর-যত্ন করে। ইন্ডিয়ায় আগে এটা মনে হয়নি কখনও।’’ এ দেশে পথ-ঘাটে নানা জন্তু-পাখি, হনুমান আর গণেশের গল্প মিলেজুলেই তাঁকে ‘লাইফ অব পাই’ লেখার প্রেরণা জুগিয়েছে। ১৯৯৭ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে এক সুন্দরীর টানে তাঁর সঙ্গী হয়েই প্রথম ভারতে আসা! মেয়েটির সঙ্গে জমল না, কিন্তু এক আশ্চর্য দেশের প্রেমে পড়লেন। তার পরের এক ভারত-সফরে মহারাষ্ট্রের মাথেরন শৈলশহরে প্লটটা মাথায় খেলে গেল। ‘‘গল্পে লজিকের জাঁতাকল থেকে বেরিয়ে ম্যাজিক দিয়ে আমাকে ভাবতে শিখিয়েছে ভারত!’’
আদতে ধর্মহীন ইয়ানের বই অসম্ভবকে বিশ্বাসেরও কাহিনি। যা পড়ে বারাক ওবামা সাক্ষাৎ ঈশ্বরের অস্তিত্বের স্মারক খুঁজে পেয়েছিলেন। ধর্মে মেয়ে-সমকামী-বিধর্মীদের প্রতি বিদ্বেষ ইয়ানের না-পসন্দ! কিন্তু ধর্মীয় প্রতীকের সূক্ষ্মতা ধরতে না-পারাটা দুর্ভাগ্যের মনে করেন তিনি। চার খুদের বাবা ইয়ান বলছিলেন, ‘‘ওরা সব কিছু ওদের মতো করে ভাবে। গল্প আর ঈশ্বরহীন ছোটবেলা বড্ড কষ্টের!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy