(নীচে) গৌরব পুরকাইত। (উপরে) মা ও বাবা। —নিজস্ব চিত্র।
সারা পাড়া এক ডাকে চিনত বছর আঠেরোর গুল্লুকে। অসুস্থ মানুষকে রাতবিরেতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই হোক বা পাড়ার কেউ মারা গেলে অসময়ের শ্মশান-বন্ধু— সকলের আগে থাকত ছটফটে, করিৎকর্মা গুল্লু। পাড়ার সব ক’টা খুদে গুল্লুদাদা বলতে অজ্ঞান। গুল্লু থাকলে যে কোনও অনুষ্ঠানবাড়িতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেন বাড়ির কর্তা। মঙ্গলবার রাতে ঠাকুরপুকুরের দীপ্তিকণা আবাসনের ছাদ থেকে পড়ে মৃত তরুণ গৌরব পুরকাইতের এমন পরিচয়ই মিলল এলাকা ঘুরে।
গৌরবের এই অকালমৃত্যুতে আক্ষরিক অর্থেই সারা পাড়া ভেঙে পড়েছে ‘মাতৃ ভবনে’। বিষ্ণুপুর থানা এলাকায় চড়কতলার রসকুঞ্জ পাড়ার এই বাড়িতেই থাকতেন গৌরব। দাদু, বাবা, মা, কাকা, পিসি, দাদা, ভাই, বোন— সবাইকে নিয়ে জমজমাট ছিল পুরকাইত পরিবার। কিন্তু একমাত্র ছেলের মৃত্যুর খবর আসার পরে মঙ্গলবার রাত থেকেই শুধু কান্না আর হাহাকারে ছেয়ে আছে বাড়ি। প্রতিবেশীদের ভিড়ের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটাই কথা— ‘‘বড় ভাল ছেলে ছিল।’’
রাতে খবর এসেছিল আবাসনের ছাদ থেকে পড়ে মারা গিয়েছেন গৌরব। তবে তখনও কেউ জানতেন না, নিছক দুর্ঘটনার জেরে পড়ে যাননি তিনি। পড়ে গিয়েছেন এক ব্যক্তির পোষা কুকুরের ভয়ে পাঁচিলে পিঠ ঠেকে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে। সকালে আসল ঘটনা জানাজানির পর থেকেই আর চাপা থাকেনি রাগ। আঠেরো বছরের একটি ছেলের সঙ্গে কেউ কী করে এতটা অমানবিক হতে পারেন— রাগে-ক্ষোভে স্তম্ভিত পরিবার থেকে আত্মীয়-বন্ধু সকলেই।
মঙ্গলবার রাত থেকেই কাঁদতে কাঁদতে বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন টুকাই পুরকাইত। গৌরবের মা। পাশে রাখা জল-মুড়ির বাটি ছুঁয়ে দেখা হয়নি এক বারও। শুধু বলে চলেছেন, ‘‘এমনি এমনি পড়ে যাওয়ার ছেলে ও নয়। অত বড় একটা কুকুর গায়ে উঠে পড়ল বলেই...।’’ শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন মা।
জোকার একটি বেসরকারি স্কুলে আয়ার কাজ করেন টুকাইদেবী। স্বামী গৌতম পুরকাইতের তেমন রোজগার নেই। বিয়ের পর থেকেই তাই পাড়ায় টিউশন পড়াতেন টুকাই। সেই টাকাতেই মানুষ করেছিলেন একমাত্র ছেলে গৌরবকে। বিদ্যানগর কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র গৌরব গত বছর একটা মোটরবাইক কিনেছিলেন শখ করে। কিছু টাকা ধারও করতে হয়েছিল সে জন্য। টুকাই জানালেন, ওই ধারের টাকা মেটাতেই গত এক বছর ধরে এসি মেশিনের টুকটাক কাজ করছিলেন গৌরব। দেনা মিটেও গিয়েছিল। এ বছর ফাইনাল ইয়ারে উঠতেন তিনি। ‘‘ছেলেটা বলত, আর এ সব কাজ করব না। এ বার মন দিয়ে পড়াশোনা করে একটা চাকরি করব।’’— বলতে বলতে গলা বুজে আসে ঠাকুরমা কল্পনা পুরকাইতের।
বাবা গৌতম পুরকাইত নিস্তব্ধ। শান্ত গলায় কেবল এক বার বললেন, ‘‘ছেলেটাকে মেরে ফেলল, শাস্তি হবে না?’’
একই কথা ৭৩ বছরের ঠাকুরদা মদন পুরকাইতের। মদনবাবু বুধবার সকাল থেকে থম মেরে বসে বাড়ি লাগোয়া ছোট্ট মুদির দোকানে। এ দিন ঝাঁপ খোলেননি। ‘‘আমার পরিবারের একমাত্র ছেলেটাকে মেরে ফেলল। গরিব বলে কি ন্যায়বিচার পাব না আমরা?’’— অসহায় প্রশ্ন মদনবাবুর।
বাড়িতে থাকলেই খুড়তুতো বোন শার্লির সঙ্গে দিনভর খুনসুটি চলত গৌরবের। মঙ্গলবার সকালেও গৌরব বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে কথা হয়েছিল দাদা-বোনের। দাদা যে আর ফিরবে না, বিশ্বাসই হচ্ছে না নবম শ্রেণির ছাত্রী শার্লির। গৌরবের মৃত্যুর সুবিচার চায় সে-ও।
কাঁটাপুকুরে ময়না-তদন্ত হওয়ার পরে এ দিন বিকেল চারটে নাগাদ রসকুঞ্জের বাড়িতে আনা হয় গৌরবের দেহ। ধরে রাখা যায়নি মা টুকাইদেবীকে। ছেলের দেহ আঁকড়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। এক জন প্রতিবেশীরও তখন চোখ শুকনো নেই। বাড়ি থেকে এগিয়ে রাস্তার পাশেই ছোট একটা পাথরের উপরে একা বসেছিল তন্ময়। গৌরবের খুড়তুতো ভাই। ‘‘দাদা খুব ভাল ছিল। খুব আনন্দ করতাম আমরা। ওকে ছাড়া কোনও আসর জমত না।’’— ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বছর পনেরোর কিশোর।
খুড়তুতো দাদা রাজা পুরকাইত একা হাতে সামলাচ্ছেন সব দিক। মঙ্গলবার রাতে খবরটা আসার পর থেকে বাড়ি-থানা-হাসপাতাল-মর্গ-শ্মশানে ছুটে বেড়াতে গিয়ে এখনও এক ফোঁটা চোখের জল ফেলার সময় পাননি। বললেন, ‘‘কাঁদার সময় নয় এটা। দাঁতে দাঁত চেপে লড়তে হবে। ভাইয়ের মৃত্যুর সুবিচার হোক, এটুকুই চাই এখন।’’
বিকেল পাঁচটা নাগাদ বজবজ শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয় গৌরবকে। সেখানেই শেষকৃত্য হয়েছে তাঁর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy